সাজিদ ও ফারুক দুজনেই ছোটবেলার বন্ধু। শৈশব থেকেই দুজনের পথ চলা একসাথে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন দুজনেরই গন্তব্য যেন দুই মেরুতে। একসময় মাদ্রাসা পড়ুয়া সাজিদের পড়াশোনা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত – “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” হলেও ফারুক পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান -“শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে”। করোনা মহামারীতে দুজনেই সময় পার করছে এখন তাদের নিজ বাড়িতে।
‘যানজট আর কোলাহলপূর্ণ এক ব্যস্ত নগরী কে পেছনে ফেলে তাদের গ্রামীণ জীবন হয়ে উঠেছে উপভোগ্য। প্রায় প্রতিদিনকার মত আজও তাদের আড্ডা জমেছে ছায়াসুনিবিড় শীতল হাওয়ায় পরশ বুলানো রাস্তার ধারে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ছোট ভাই – ‘আবরার’। আজকের আড্ডার একটু ভিন্ন ধরনের। বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত সাজিদ প্রায় কথা বলে ‘সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিয়ে। সাজিদ প্রশ্ন করল – ‘ফারুক’ তুই কি সেকুলারিজম সম্পর্কে জানিস?
ফারুক বলে- হ্যাঁ জানি। Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বুঝায় –‘পার্থিব, ইহজাগতিক, ধর্মহীনতা’। ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলা আছে –‘Rejects all form of religious faith’. অর্থাৎ এটি হলো এমন দর্শন যা সকল প্রকার ধর্মবিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়।
Encyclopedia of Britannica তে বলা আছে-‘যারা কোন ধর্মের অন্তর্গত নয, কোন ধর্মে বিশ্বাসী নয় এবং আধ্যাত্মিকতা, জবাবদিহিতা ও পবিত্রতা বিরোধী’ তাদেরকে বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ। তাছাড়া Oxford Dictionary অনুযায়ী –‘আল্লাহতে বিশ্বাস ত্যাগ করে মানবজাতির বর্তমান কল্যাণ চিন্তার উপর ভিত্তি করে নৈতিকতা নৈতিকতা ঘরে উঠাই হল ধর্মনিরপেক্ষতা ‘ ।[Wikipedia]
জাহেলিয়াতে ঘেরা জাহান- ওমর আরিফ– পড়ুন
বাহ! তুইত অনেক খোঁজখবর রাখছিস ‘ফারুক’! অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে বলল-সাজিদ। তাহলে তুই কি জানিস বাংলাদেশের সংবিধানেও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে? ফারুক বলে- হ্যাঁ জানি, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪ টি মূলনীতির একটি হল – ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ [Part-2,article :8,The constitution of Bangladesh ] সাজিদ বলে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও মুসলিমদের সহবস্থানের জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ঘটন করতে চেয়েছিলেন। ফারুক বলল-তাহলে আমাদের এটাও জানা উচিত যে, ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সাথে ইসলামকেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে [part-1,article :2A,The constitution of Bangladesh ]। (বি.দ্রঃ সংবিধানে “আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থা” স্থাপন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে আর ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ১৯২৮ সালে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর সেই চিন্তা-চেতনাও ইসলামের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাজিদ বলে- কি? সেটা কিভাবে)। সম্ভব! ইসলাম তো শুধু মুসলিমদের অধিকার নিয়ে কথা বলে। হ্যাঁ, শুধু সম্ভবই নয় আর এটা ইসলামের মূল শিক্ষার অন্যতম একটি। যার প্রমাণ মেলে রাসূল (সা.) এর মদিনা সনদে। যেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী সব সম্প্রদায় একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে ও সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে, প্রত্যেকেরই পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। (সীরাতে রাসূলুল্লাহ,ইবনে ইসহাক)। তাছাড়া পবিত্র কোরআনেও উল্লেখ আছে যে,
“ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আমার জন্য আমার ধর্ম “ (৬,সূরা কাফিরুন)। আর ইসলামে জোরজবরদস্তিরও কোন স্থান নেই। কোরআন বলছে – ‘ধর্ম ও জীবন বিধান (ইসলাম) গ্রহণে কোন বল প্রয়োগ নেই ‘(বাকারাহ’২৫৬) তাছাড়া ইসলাম সত্যের পথে আহ্বান করার পাশাপাশি ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রদান করেছে চাইলেই সে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে, এতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সেজন্যই কোরআন বলছে –“এটি (কোরআন) একটি উপদেশ অতএব যার ইচ্ছা হয় নিজের রবের পথ অবলম্বন করুক”( ১৯,সূরা মুজাম্মিল)। ইসলামের এই সুমহান শিক্ষা যথার্থভাবেই বুঝেছিলেন বলেই বাঙ্গালী জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গণপরিষদে বিতর্কে বলেছিলেন –‘ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। [বাংলা ট্রিবিউন] যার বাস্তব চিত্র দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বক্তব্য তিনি বলেন-‘তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর অনুমোদন কে সমর্থন করেন’ [Asia News]। সেজন্য Wikipedia তথ্যমতে বলা হয়েছে -দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমাদের থেকে অনেক ক্ষেত্রে পৃথক যেখানে রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক বৈষম্যকে স্বীকার না করে ধর্ম চর্চা করার স্বাধীনতা দান করেন। সাজিদ বলল -সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। ফারুক বলে- কিন্তু তোমরা কমিউনিজমের তকমা লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে যুবকদের ধর্মহীনতার দিকে আহবান করছো এটাকি সুস্পষ্ট প্রতারণা নয় কি? সাজিদ উত্তেজিতভাবে বলল, তার মানে তুই কি বলতে চাচ্ছিস কমিউনিজম এক ধরনের প্রতারণা?
দীর্ঘ সময় কথা শোনার পর আবরার বলে উঠলো -এসব নাস্তিক্যবাদ লালনকারী মানুষগুলো কুলাঙ্গার ছাড়া আর কিছুই নয়। ফারুক প্রবল আপত্তির সাথে আবরারকে নিষেধ করে বলল- না, ইসলাম আমাদেরকে এভাবে আক্রমণাত্মক মনোভাবের শিক্ষা দেয় না। আর সাজিদ সরি বন্ধু, আমরা বলছি না, এটা তোমাদের প্রচলিত কর্মকান্ডের প্রামাণিক দলিল মাত্র। যেমনঃ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে কোন ধর্ম বা পবিত্রতার বিশ্বাসী নয় সেই মানুষগুলোই আমাদের সংবিধানের ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ কে আক্রমণ করতে গিয়ে আমাদের সংবিধানকে পবিত্র বলে উল্লেখ করছেন এটাকি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়! সাজিদ বলল- কিন্তু কমিউনিজম ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে মানবতার পক্ষে শ্রেণি বৈষম্যহীন একটি সমাজ তৈরি করতে চায়। ফারুক বলল, তোমাদের আদর্শের ব্যক্তিরাই যখন জলাঞ্জলি দিয়েছিল মানবতাকে আর সেই তোমরাই মানবাধিকারের বুলি ছড়াচ্ছ! এর মানে তুই কি বোঝাতে চাচ্ছিস ফারুক?
ফারুক বলল, এটা খুবই সহজ যেটা যুগ যুগ ধরে পর্দার আড়ালে রেখে আমাদের যুবসমাজকে প্রতারিত করা হয়েছে। যেমনঃ শুধুমাত্র কমিউনিজমকে মেনে না নেয়ার কারণে কমিউনিস্ট লিডাররা নির্বিচারে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করে। জরিপ অনুযায়ী পাঁচ বছরে তারা হত্যা করেছিল ১৮,৬০০০০ মানুষকে। [তথ্সূত্র]
চে গুয়েভারা বিপ্লবী মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে খুন-ধর্ষনের জঘন্য কালো ইতিহাস। যার নির্দেশনায় প্রসূতি নারীদের পেটে গুলি করে মা-সন্তানদের হত্যা করা হয়[ তথ্সূত্র] মাও সে তুং ও স্ট্যালিনের মাধ্যমে কমিউনিজম এর যাত্রা শুরু হয় রক্তে রাঙানো ইতিহাসের মাধ্যমে [ তথ্সূত্র] তারপরও কি তুই এটা বলবি মানবাধিকারের শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা?
সত্যিই! ফারুখ এটা আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে- সাজিদ বলল। শুধু তাই নয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু মুখে মুখে প্রচার করে একদল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা মিডিয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নাস্তিক্যবাদী চিন্তা চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদেরকে বাঙালি ও মুসলিম দুটি পরিচয় দাঁড় করান। অথচ আজকে যারা মিডিয়ার সামনে নিজেকে চেতনাধারী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কোন প্রমাণ মেলে না। এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা দাবি করেন যিনি বাঙ্গালী তিনি কখনো মুসলমান কিংবা হিন্দু হতে পারে না। তারা বলেন, সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি বাঙালি কিন্তু বাঙ্গলি জাতির ইতিহাস কি এরূপ ছিল? বরং আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস হল বাঙ্গালী সকল ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালনের সহাবস্থানের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। আর সেজন্যই আমার দেশ, আমার সংবিধান ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে যেভাবে স্বীকৃতি দেয় ঠিক তেমনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের সহবস্থান কে সমুন্নত রাখে। [part-2,article:12,The constitution of Bangladesh ]
আর্যদের থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বাঙালির সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে নানা ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলনে এইজন্যই বলা হয়ে থাকে- ‘বাঙ্গলি সংস্কৃতি নদীর মতোই বহমান’। তাই মুসলিমদের সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি মেনে না নেয়া বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে বিভেদের রেখা উন্মোচন করাই ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এক শ্রেণীর মানুষের ঘৃণ্য চক্রান্ত ফুটে ওঠে। তথাকথিত এসব সেকুলারিষ্টরা মুক্তচিন্তার নামে আমাদের তরুণদের কে বিভ্রান্ত করছে। পাশ্চাত্যের অনুসরণের মাধ্যমে ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ অশ্লীলতার দিকে। এই যেমন সম্প্রতি বহুল সমালোচিত ‘ওয়েব সিরিজের’ নামে যে ভয়াবহ অশ্লীলতা এবং কুরুচিপূর্ণ ভিডিও YouTube e upload করা হয়েছে সে গুলোকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে একশ্রেণীর তথাকথিত সেক্যুলার সাংবাদিকরা। কিন্তু এহেন কর্মকান্ড কি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আমরা দেখতে পেয়েছি! না বরং বাঙালি সংস্কৃতি শালীন ও সুরুচিপূর্ণ একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি।
তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব এলিয়ক, যিনি ধর্মের কোন রকম সমালোচনা ছাড়াই সমাজে শৃঙ্খলা আনয়নের ধারণা প্রকাশ করেন। অথচ হাল কালের বাঙ্গালি সেক্যুলারিস্ট মানেই ইসলামকে’ কে আক্রমণ করে বাঙালি মুসলিমদেরকে কটাক্ষ করা। সাজিদ বলল, সত্যিই! আমাদের না জানা, না বলা কথা গুলো লুকিয়ে রেখে যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে মুক্তচিন্তার নামে নাস্তিক্যবাদের দিকে। আবরার বলল, নাস্তিক্যবাদ নিয়েও আমাদের বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। ফারুখ বলে, সেটা নিয়ে আমরা অন্য কোন একদিন আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম বন্ধু! সাজিদ বলল।
‘পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভার অবসানে গোধূলি লগ্নে শেষ হলো সেদিনের মত আড্ডা। মিনার থেকে ভেসে আসা আযানের সুরের তালে তালে পাখিরা যেমনি ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে তেমনি সাজিদ তার বাড়ির পানে ছুটলেও ফারুক ও আবরারের গন্তব্য-‘মসজিদে’