উর্মি আচার্য্য। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বাবাকে বাচাঁতে লিভারের ৬৭ শতাংশ দান করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি সুষ্ঠুভাবে লিভার সিরোসিস অপারেশন করে বাবাকে নিয়ে দেশে ফেরেন উর্মি।
একদিকে পরিবারের উপার্জনকারী ছিলেন অন্যদিকে বাবার চিকিৎসার জন্য ২৫ লক্ষ টাকার পাহাড়সম বোঝা নিয়ে সংগ্রাম করেন। উর্মি বাবাকে বাচাঁতে যে সংগ্রাম করেছেন, তা জানাচ্ছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদিন।
একুশে টিভি অনলাইন: বাবাকে লিভার সিরোসিসের অপারেশন করে দেশে এসে কেমন অনুভূতি হচ্ছে?
উর্মি আচার্য্য: বাবাকে সুস্থ করাটা আমার কর্তব্য ছিল। বাবাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছিলাম। সবাই যেভাবে সহযোগিতা করেছে, সুষ্ঠুভাবে দেশে ফিরতে ফেরে আমার অঙ্গীকার ও সবার প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন হয়েছে।
একুশে টিভি অনলাইন: বাবাকে লিভার দেয়ার চিন্তা কিভাবে এল?
উর্মি আচার্য্য: বাবাকে সুস্থ করার একমাত্র পথ ছিল লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা। এক্ষেত্রে একজন ডোনারের দরকার হয়। ডোনার হওয়ার জন্য কি কি করতে হয় তা প্রথমে নিজেই গিয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করি এবং বিভিন্ন টেস্ট করি। তারপর বাবাকে জানাই পুরো প্রসেসিং এবং উনাকে রাজি করাই।
একুশে টিভি অনলাইন: পরিবারের প্রধান উপার্জন ও আপনার বাবার চিকিৎসার ব্যাপারে কিছু বলেন?
উর্মি আচার্য্য: দিল্লীতে চিকিৎসা আরো কিছুদিন চালিয়ে যেতে বলেছিল ডাক্তাররা। কিন্তু সব টাকা শেষ হওয়ায় আমাদের দেশে চলে আসতে হয়েছে। ডা. সুভাষ গুপ্তাকে ব্যাপারটা বলাতে আমাদেরকে বাংলাদেশ আসতে দিয়েছেন। তবে দেশে প্রতি এক সপ্তাহ পর পর টেস্টগুলো করে ইমেইলে পাঠানোর জন্যে বলেন তিনি। টেস্টগুলো অনেক ব্যয়বহুল ও মেডিসিনের দামও অনেক। আমি সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলাম। তবে এখন বাবাকে লিভার দেয়ার কারণে আমিও কোন উপার্জন করতে পারব না। তাই অনেক দুশ্চিন্তায় দিন পার করতে হচ্ছে।
একুশে টিভি অনলাইন: সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে না পারার অনুভুতি কেমন ছিল?
উর্মি আচার্য্য: আমার সহপাঠিরা যখন সমাবর্তনের গাউন ট্রায়াল দিচ্ছিল, ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল তখন বাবা-মেয়ে দুইজনই নিজেদের জীবন নিয়ে যুদ্ধ করছিলাম। সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে না পারার কষ্টতো অবশ্যই ছিল (সুপ্ত)। তবে বাবার শারীরিক অবস্থার উন্নতিতে আমার কষ্ট সুখে পরিণত হয়েছে এবং এই উন্নতিই সমাবর্তনের সম্মাননা আমার পাওয়া হয়েগিয়েছিল।
একুশে টিভি অনলাইন: সবার কাছ থেকে কেমন সাড়া পেয়েছিলেন, তাদের উদ্দ্যেশে কিছু বলুন।
উর্মি আচার্য্য: ফেইসবুকের বিভিন্ন ট্যাটাস ও নিউজ গুলোর কারণে সবাই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (বিশেষ করে বিভাগের সকল শিক্ষক), সহপাঠি, বড় ও ছোট ভাই বোন সহ সকলেই এগিয়ে এসেছিল। কুমিল্লার পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক, জাগ্রত মানবিকতা, সিটি মেয়র, চট্টগ্রাম সমিতি, জাগো হিন্দু পরিষদ, নরসিংদীর কাদের মোল্লাসহ সকলের সহযোগিতার কারণে আমার বাবার চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন- থিয়েটার, ডংড়ি এবং উদ্যোক্তা মেলা এর বিশেষ ভুমিকা ছিল। সকলের সহযোগিতা ছিল বলেই আমি পেরেছি, সেজন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
একুশে টিভি অনলাইন: কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছিলেন কিনা।
উর্মি আচার্য্য: প্রতিবন্ধকতা বলতে প্রথমদিকে ভলান্টিয়ার ছিল না। তাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য জায়গা থেকে কোন ফান্ডিং করা সম্ভব হয়নি। সেসময় ছিল আমার জন্য সব থেকে কষ্টের। তাই নিজেই ভার্সিটির বড় ও ছোট ভাইদের সহযোগিতায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছি। আমার বড় বোন শর্মি আচার্য, ছোট বোন পূজা এবং ছোট ভাই অন্তু ও বন্ধু পঙ্কজ মিলে। আবার অনেকেই আমাদেরকে প্রতারক ভেবেছিল, এক শ্রেণির লোক আমার বিকাশ একাউন্টের টাকা হ্যাক করার চেষ্টাও করেছে বহুবার।
একুশে টিভি অনলাইন: বাবার অসুস্থতা কবে থেকে?
উর্মি আচার্য্য: ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আমার ৩য় সেমিষ্টার ফাইনাল ছিল, তখন হঠাৎ রাতে রক্ত বমি হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল এ ভর্তি করানো হয়। তখন রোগটি ধরা পড়ে।
একুশে টিভি অনলাইন: চিকিৎসার জন্য আর কত টাকা দরকার?
উর্মি আচার্য: বাবার চিকিৎসার জন্য আরও চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা দরকার। প্রতিমাসে টেস্ট ও মেডিসিনের জন্য ২০-২৫ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। এক সপ্তাহ পর পর টেস্টগুলো করে দিল্লিতে ডাক্তারের কাছে মেইল করতে হয়।
একুশে টিভি অনলাইন: নিজের সাহসের জায়গাটা নিয়ে কিছু বলবেন কিনা।
উর্মি আচার্য্য: যেহেতু আমার ব্লাড গ্রুপ এবং বাবার ব্লাড গ্রুপ একই, তাই নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে টেস্ট করিয়েছি, আমি ফিট কিনা। যখন, আমি জানতে পারলাম আমি ফিট তখন নিজেই নিজের কাছে সংকল্প করেছি, আমার শেষ নিঃশাস পর্যন্ত লড়াই করবো বাবাকে বাঁচাতে। সবাই (কুবি পরিবারসহ সকল জনগন) যেভাবে এগিয়ে এসেছে তাতে আমার সাহস আরও বেশি বেড়ে গেছে। আমার পরিবারের সবাই একটা টিমের মত কাজ করেছি। আমার ছোট ভাই ও বোন, মা, দিদি এবং বন্ধু পঙ্কজ আমাকে সাহস দিয়ে গেছে তাই হতাশা আমাকে গ্রাস করতে পারেনি।
একুশে টিভি অনলাইন: আপনার বাবার অনুভুতি কেমন?
উর্মি আচার্য্য: আমার বাবা বলেন, জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাঁর তিন কন্যা ও এক ছেলে। ঈশ্বরের কৃপায়, তার সন্তানদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় এবং সকলের আর্থিক সহযোগীতায় ও শুভ কামনায় আমি সুস্থ হতে পেরেছি।
একুশে টিভি অনলাইন: নিজের কোনো অভিজ্ঞতা শেষ করবেন?
উর্মি আচার্য্য: উদ্দেশ্য সৎ ও চেষ্টা থাকলে সবই সম্ভব। আর ভাল কাজে বাধা বেশি থাকে, কিন্তু ধৈর্য্যসহ সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রেখে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই।
একুশে টিভি অনলাইন: রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বিষয়ে কোন পরামর্শ আছে।
উর্মি আচার্য্য: রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। তবে আক্রান্ত হলে আশা না ছেড়ে সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া উচিত ও সৃষ্টিকর্তার কৃপা প্রার্থনা করা।