স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে বরুড়া উপজেলার খোশবাস উত্তর ইউনিয়নের খোশবাস বাজারে অবস্থিত খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত মমিনুল হক ভূঁইয়া। তৎকালীন সময়ে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি এ পাশ করে ডাক বিভাগের উচ্চ পদের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরী করেন। চাকরী থেকে যখন অবসরে গ্রামে চলে আসেন তখন একটা স্কুল করার পরিকল্পনা করেন এবং খোশবাস গ্রামের দানবীর জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার কাছে যায়গা চেয়ে নিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পর্কে মমিনুল হক ভূঁইয়ার দাদির আপন ভাই ছিলেন জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া। ঐ স্কুলে মমিনুল হক ভূঁইয়া ১৩ বছর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থেকে ১৯৮২ সালে অবসরে চলে আসেন।
সাম্প্রতিক সময়ে অত্র এলাকার স্থানীয় সাংবাদিক মো. ইউনুছ খান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন, “খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এর জমি দাতার নাম জানতে পঞ্চাশ বছর লেগেছে তাহলে স্কুল প্রতিষ্ঠাতার নাম জানতে কি আমাদের আরো পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হবে?” ইউনুছ খানের এ স্ট্যাটাসে জমির খাঁ ভূঁইয়ার উত্তরসূরী প্রয়াত জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ও প্রয়াত মমিনুল হক ভূঁইয়ার আত্মিয়স্বজন,স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। যা নিম্মে উল্লেখ্য করা হলো।
প্রয়াত মমিনুল হক ভূঁইয়ার দৌহিত্রী আমেরিকান প্রবাসী ফাহমিদা সুলতানা বলেন, “এ স্কুলের জমি দাতা জয়নুল আবেদীন এবং প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মমিনুল হক ভূঁইয়া। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন (১৯৬৯-১৯৮২ )সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্মটা এভাবে হয়নি, যিনি জমি দান করেন তিনি ছিলেন মমিনুল হক সাহেবের দাদির ভাই জয়নুল আবেদিন সাহেব। মমিনুল হক সাহেব জমিটা উনার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে সেখানে খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় করেছিলেন। সেই ইতিহাসের সাক্ষি হচ্ছে জমির খাঁ ভূঁইয়ার পরিবারের সবাই। মমিনুল হক সাহেবে যখন মারা যান তখন সবাই চেয়েছিল উনার দাফন স্কুল মাঠে যেন হয়, কিন্তু হক সাহেবের পরিবারের সবার ইচ্ছায় সেদিন সেই দাফন পারিবারিক কবর স্থানে হয়। হক সাহেব ছিলেন বলেই আজকে এখানে স্কুল হয়েছে।হক সাহেবের একজন প্রাক্তন ছাত্র হাইস্কুল কে কলেজে উন্নতি করতে সহায়তা করেন। এই স্কুলের ছাত্র রশিদ সাহেব তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিজি ছিলেন। যিনি করনায় মারা যান গত বছর।তবে পঞ্চাশ বছর পর সবাই জানতে পারল জমি দাতার নাম, এই কথার মানে আমি বুঝতে পারি নাই। জমির খাঁ ভূঁইয়ার পরিবারের ও খোশবাসের সবাই জানে ঐ স্কুলের জন্ম কিভাবে হয়েছে।
সাধারণত কোন স্কুলের গেইটে স্কুলের নাম লেখা থাকে। কিন্তু জমি দাতার নাম লেখা থাকে আমি কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।আমি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের কলেজ শাখায় শিক্ষকতা করেছি ১৭ বছর। ঢাকা শহরের বহু কলেজে ব্যাবহারিক পরীক্ষা নিতে বহু বার গিয়েছি কিন্তু আমি কোথাও দেখেনি যে, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটকে জমি দাতার নাম লেখা থাকে। মমিনুল হক সাহেব চেয়ে ছিলেন যে খোশবাসের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষার আলো থেকে যেন বঞ্চিত না হয়, সে দায়িত্ববোধের যায়গা থেকেই তিনি সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তবে আজকে আমি একটা কথা না বলে পারছিনা, সেই দিন এই স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা হক সাহেবের পক্ষে খুব সহজ কাজ ছিল না। তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন ছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। আমি স্কুল এন্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদ কে আহবান করে বলব, আপনারা স্কুল গেইটে জমিদাতার নাম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার নাম দিয়ে কোন ভাবে দায় এড়াতে পারেন না। আপনার অবিলম্বে দুইজন কৃতিমান মানুষ কে সম্মান করে স্কুলের ভিতরে একটা নামফলক করে নতুন প্রজন্ম কে সঠিক ইতিহাস জানাবেন।
খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইনজামানুল হক সৈকত বলেন, “খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয়ের অস্তিত্বের সাথে মিশে রয়েছে মমিনুল হক সাহেব। কেননা উনি এ স্কুল প্রতিষ্ঠা না করলে হয়ত আজ খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হত না৷ সুতারং কর্তৃপক্ষের নিকট আকুল আবেদন, প্রতিষ্ঠাতার নাম যেন এই পলকে দেওয়া হয়”।
ফয়সাল মাহমুদ বলেন, “কোন স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসার তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গেইটে নামের পাশে সৌন্দর্য বর্ধনে কারা কাজ করছে সেই লেখা থাকার মানে কি? তাদের নামের প্রচার? এগুলো হচ্ছে হীনমন্যতার পরিচায়ক”।
জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার উত্তরসূরী খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী নিলুফার কবির রেখা বলেন, ”আমার মতে জমি দাতার নামের পাশে প্রতিষ্ঠাতার নামও দেয়া উচিত ছিল। এখানে কারো অবদান কম নয়। জয়নুল আবেদীন ভূঁইয়া সাহেব আমার দাদা ছিলেন, মমিনুল হক ভূঁইয়া সাহেবও আমার আরেক দাদা ছিলেন। উনাদের সন্মান জানাতে দুজনের নাম দিলে কার কি ক্ষতি হতো? যারা এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন তারা এটার পরিবর্তন করে নতুন করে দুজনের নাম বসিয়ে ঠিক করে আনুন। এলাকাবাসীকে দ্বিধাদ্বন্দে ফেলবেন না।আশা করি এতে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করবেন না। আমরা খোশবাস গ্রাম কে খুব ভালবাসি।এটা একটি আদর্শ গ্রাম যার তুলনা হয় না”।
জমির খাঁ ভূঁইয়ার আরেক উত্তরসূরী প্রবাসী আবদুল্লাহ লোকমান বলেন, “আমার অভিমত হলো এভাবে প্রধান ফটকে দাতা বা প্রতিষ্ঠাতার নাম উপস্থাপন উনাদের কিছুটা হলেও আমজনতার কাছে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।এখানে যা করা যেতে পারতো তা হলো,পরম শ্রদ্ধেয় জমি দাতা প্রয়াত জয়নুল আবেদীন সাহেব ও বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রধান শিক্ষক পরম শ্রদ্ধেয় মমিনুল হক ভূঁইয়া সাহেব দুজনের শুধু নাম অংকিত নয়, বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে স্থায়ী শিলা লিপিতে ওনাদের নাম,কর্ম জীবন,সমাজ সেবা ও জন্ম,মৃত্যু তথ্য উপস্থাপন করলে এখানে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী সহ আগত সকলেই এক নজরে বিদ্যালয়ের জন্য অবদান রাখা উনাদের সম্পর্কে তাদের জ্ঞানগর্ব ধারনা নিয়ে যেতে পারবেন।প্রধান ফটকে এভাবে উপস্থাপন করাটা আমার ব্যাক্তিগত ভাবে দৃষ্টিকটু লাগছে।কেননা উনারা খোশবাসের প্রথম আলোর ফেরিওয়ালা।শিক্ষা প্রসারের অগ্রদূত”।
জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার আরেক উত্তরসূরী আমেরিকান প্রবাসী মো. কামাল আবেদীন ভূঁইয়া বলেন, “সাইনবোর্ড টা দেখে খুব খারাপ লাগল।প্রতিষ্ঠাতার নাম লেখা নিয়ে আমাদের এত অবহেলা কেন? মমিনুল হক সাহেব(দাদা ভাই)স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন না দেখলে হয়ত এখানে স্কুলই হতনা।খোশবাসের সবাইকে অনুরোধ করব সাইনবোর্ড টা যেন পরিবর্তন করা হয়”।
খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী জমির খাঁ ভূঁইয়ার উত্তরসূরী অস্টেলিয়ার বায়োটেকনোলজিষ্ট ড. সুলতানা পারভিন বলেন, “এরকম সাইনবোর্ড বোধহয় এই প্রথম দেখলাম, সাইনবোর্ড এ প্রতিষ্ঠাতার নাম এবং সাল লিখা থাকে কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার কোন নাম নেই, জমিদাতার নাম দিয়ে সাইনবোর্ড লাগানো এটা কি কোন নতুন সিষ্টেম নাকি বুঝতে পারলাম না, ধরে নিলাম কেউ স্কুলের জন্য জমি দান করল, সেটাই কি স্কুল প্রতিষ্ঠা নিশ্চয়তা দিল? যতক্ষন পর্যন্ত স্কুল না হল সেটা শুধুই জমি রইল।
আমিত ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি মমিনুল হক ভূঁইয়া তিনি আমাদের দাদা ছিলেন, তিনি এ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং এলাকার উন্নয়নে উনার অবদান কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? ছোটবেলায় দাদাকে দেখেছি কেমন আড়ম্বরহীন জীবন যাপন করেছেন”
প্রয়াত মমিনুল হক ভূঁইয়ার আরেক নাতনি দিলশাদ জাহান খান বলেন,”এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার নাতনি হিসেবে সত্যি আজ দুঃখিত ও লজ্জিত আমরা। যিনি খোশবাস কে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করেন এবং দীর্ঘ তের বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন, আজ তার নাম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাই। মমিনুল হক ভূঁইয়া খোশবাস তথা ওই ইউনিয়নের গর্ব ছিলেন। তিনি যে শিক্ষার আলো খোশবাসে জ্বালিয়েছেন, সেই আলো তে আলোকিত হয়ে তার উত্তরসূরীরা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আলো ছড়াচ্ছে। খোশবাসে এমন কে আছেন যিনি জানেন না এই বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা কে?? এতোটা হীনমন্যতার পরিচয় কেন দেওয়া হলো মমিনুল হক ভূঁইয়া পরিবারের পক্ষ থেকে জানতে চাই?”
খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন,” জমি দাতা জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া সাহেব ও স্কুল প্রতিষ্ঠাতা মুমিনুল হক সাহেব কে স্বশ্রদ্ধ সালাম। উনাদের আন্তরিকতায় উন্নত জাতি গঠনের অবদান হিসেবে খোশবাস ইউনিয়নের আপামর জনসাধারণ চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। উনাদের যথাযথ মর্যাদা দিতে আমরা পারি নাই। আমি আশা করি খোশবাস ইউনিয়নের বিবেকবান মানুষ গুলো উনাদের যথাযথ মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনে এগিয়ে আসবেন।”
তবে এই বিষয়ে খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহ আলম বলেন, “আমরা চার বছর যাবৎ পরিচালনা পর্ষদ স্কুলের প্রধান ফটক নির্মাণ করার লক্ষ্যে কাজ করে আসছি। স্কুলের জমি দাতার পরিবার আমাদের কাছে একটা আবেদন রেখেছেন আমরা যেন জমি দাতা জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার নামটি রেকর্ডে রাখি। আমরা তাদের আবেদনের বিষয়টি মাথায় রেখে জমি দাতার নাম প্রধান ফটকে লিখে দিয়েছি। যেহেতু এটার কোন রেজুলেশন নেই প্রতিষ্ঠানের কাছে। এখন নতুন করে যদি অন্য কোন পরিবার আমাদের কাছে আবেদন করে তাহলে আমাদের গভর্ণিং বডির সভায় আলোচনা হতে পারে”।
এ বিষয়টি নিয়ে অনেক আধুনিক মনস্ক গুনীজনের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, ” একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা স্কুলের একটি সিম্পল ও স্মার্ট সাইনবোর্ড আশা করছি, যেখানে স্কুল কলেজের নাম আর প্রতিষ্ঠা সাল লেখা থাকবে, আর কোন বাহুল্য যেন এতে স্থান না পায়। আর প্রতিষ্ঠাতা, জমিদাতার নাম স্কুল প্রাঙ্গণ এ আলাদা ফলকে খোদাই করে রাখা যেতে পারে।