স্থানীয়দের দাবি ডুবে লঞ্চটিতে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিলেন। সোমবার (২৯ জুন) সকাল নয়টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, নৌ পুলিশ দিনভর উদ্ধারকাজ চালিয়ে ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ৩টি শিশু, আর বাকি লাশের মধ্যে রয়েছে ৮ নারী ও ১৯ জন পুরুষ। মিটফোর্ড হাসপাতালে মারা গেছেন আরও দুজন। সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ঘটনাটি দেখে তাঁর পরিকল্পিত মনে হয়েছে। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। আটক করা হয়েছে ময়ূর-২। চালক পলাতক।
সদরঘাটের লঞ্চ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ছোট লঞ্চ মর্নিং বার্ডকে চাঁদপুর রুটের লঞ্চ ময়ূর-২ সোজা ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়। তখন মুহূর্তের মধ্যে মর্নিং বার্ড দুমড়েমুচড়ে ডুবে যায়।
সদরঘাটের লঞ্চ দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ লোক মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে আসেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মনছুর আহমেদ কালাম। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা একাধিক লঞ্চ নদীতে ডুবে যায়। এই ছোট লঞ্চগুলোর চলাচল একেবারই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ নদীতে বড় বড় লঞ্চ চলে। এসব লঞ্চের কারণে ছোট লঞ্চে যাত্রীদের যাতায়াত অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আমি মনে করি, বিআইডব্লিউটিএ যেন অতিসত্বর এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মিটফোর্ড মর্গে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৩২টি লাশ আনা হয়।
মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চ দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক জয়নাল আবেদিনসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছে। নৌ-পুলিশ ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। তিনি বলেন, ‘সদরঘাটের মর্নিং বার্ড লঞ্চ দুর্ঘটনায় ইতিমধ্যে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছি আমরা। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণে এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি, ময়ূর-২ নামের লঞ্চটি যাত্রী তোলার জন্য ঘাটে আসছিল। তখন ময়ূর-২-এর ধাক্কায় মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকার দিকে আসা ছোট আকৃতির লঞ্চ মর্নিং বার্ড ডুবে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে ময়ূর-২-এর লঞ্চের মালিকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় আমরা মামলা করেছি। তিনজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সদরঘাটের এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় যাঁরা দায়ী, তাঁদের সবাইকে শাস্তির আওতায় আসতেই হবে। কেউই রেহাই পাবেন না।’
বিকেল ৪টা পর্যন্ত জীবিত ফিরে আসা ৮-১০ জন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা বর্ণনা করেছেন মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখে আসার অভিজ্ঞতা।
জাহাঙ্গীর হোসেন নামের একজনের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম পৌরসভার এনায়েত নগরে। জাহাঙ্গীর বলেন, প্রতিদিনের মতো সোমবার সকাল পৌনে ৮টায় তিনি মর্নিং বার্ড লঞ্চে করে ঢাকার পথে রওনা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মীরকাদিম পৌর এলাকার প্রায় ১০ জন যাত্রী। কথা আর আড্ডা দিয়ে তাঁরা লঞ্চের ভেতরে সময় কাটাচ্ছিলেন। লঞ্চটি ফরাশগঞ্জ ঘাট এলাকায় পৌঁছায় সকাল সোয়া ৯টার দিকে। এ সময় হঠাৎ তাঁদের লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয় ময়ূর-২ নামের একটি লঞ্চ। ধাক্কা খেয়ে একপাশে কাত হয়ে যায় মর্নিং বার্ড। সবাই লঞ্চ থেকে ছিটকে নদীতে পড়তে থাকে। তিনিও পানিতে পড়ে যান। তাঁর গায়ের ওপর পড়েন ১০-১২ জন যাত্রী। চোখের সামনেই অনেকে পানিতে তলিয়ে যান। তিনিও ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠেন। কোনো রকম সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন।
নাজমা আক্তার বলেন, তিনি চিকিৎসা নিতে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। লঞ্চটি যে পাশ দিয়ে ডুবছিল, তার বিপরীত পাশে ছিলেন। সেখানকার জানালা দিয়ে তিনি বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে পরিচিত মুখগুলো লাশ হয়ে গেল। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না।’
এই দুর্ঘটনা থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা নাজমা আক্তার, জুমকি, কাকলি বেগম ও মমিন আলীও একই ধরনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তাঁদের কারোরই এর আগে ছিল না।