আমাদের দেশ! এটাই কী আমাদের দেশ! যে দেশকে নিয়ে স্বাধীনচেতা কবি দ্বিজেন্দ্রনাল রায় বলেছেন,”এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”। এটাই কী তাদের প্রাপ্তি যারা তাদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল আর ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ সম্ভ্রম হারা মা বোনের বিনিময়ে আমরা ফিরে পেলাম মহান স্বাধীনতা। আমরা কী আদৌ স্বাধীনতা রক্ষা করতে পেরেছি? নাকি হেরে গেছি একটি প্রবাদ বাক্যের কাছে,”স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন”।
এমন এক মানবতাহীন গুণে ধরা সমাজে আমরা বসবাস করছি যে সমাজকে জাহেলিয়াতের সাথে তুলনা করতে আমার দুইবার ভাবতে হয়না। এখন আর জাহেলিয়াতের ইতিহাস পড়তে হয়না! কারণ যেটা চোখের সামনে দৃশ্যমান সেটা আবার পড়তে যাবইবা কেন?
যেখানে প্রতিনিয়ত ঘটছে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনা। ধর্ষিত হচ্ছে ২ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা নারী এমনকি ছাড় পায়নি ছয় জননীর মা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, গণপরিবহনে, হাসপাতালে, কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ এক কথায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা আজ ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আজ আমরা এমন এক নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজে বসবাস করছি যে সমাজে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হলে ধর্ষকের বিরুদ্ধে কথা না বলে আমরা কথা বলি ধর্ষিতার পোশাক তুলে। আমাদের সমাজে ধর্ষকের মুক্তির জন্য গড়ে তোলা হয় আন্দোলন। সেক্ষেত্রে আপনি যদি পোশাক নিয়ে কথা বলেন তাহলে আমি আপনাকে বলবো, ২ বছরের শিশুর কোথায় সমস্যা ছিলো নাকি সমস্যা ছিলো ৮০ বছরের বৃদ্ধার পোশাকে কিংবা ছয় সন্তানের জননীর! এক্ষেত্রে আপনি কোনটাকে দায়ী করবেন নিশ্চয়ই নৈতিকতার অবক্ষয়কে। তাই আসুন আমরা,”ধর্ষিতাকে অপমান নয় বরং তার পাশে দাড়িয়ে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করি”।
দেশব্যাপী ধর্ষণের উৎসব চলছে। এইতো কয়েকমাস আগেই ব্লেড দিয়ে কেটে যৌনাঙ্গের প্রবেশ পথ বড় করে রাতভর ধর্ষণ করেছে দিনাজপুরের ৫ বছরের শিশু পূজাকে।ধর্ষণের শিকার হয়েছে ছোট্ট ফাতিমা। বাবা বিচার চাইতে থানায় গেলে, ১০০০ টাকার বিনিময়ে পুলিশ কিনতে চাইলো ফাতেমার হারানো ইজ্জত!
আমি মনে করি রমজান আলী তার মেয়ে ফাতেমাকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে ভালোই করেছে।কারণ, যেই পুলিশের কাছে সে বিচার চাইতে গেছে সে পুলিশই দুইদিন পর এক মেয়েকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে রাতভর ধর্ষণ করেছে।
এইতো কয়েকদিন আগেই ঢাকার ওয়ারীতে সাত বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সায়মাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হ্রদয় কেপে উঠেছে। বরগুনায় দিন দুপুরে রিফাত হত্যার মতো বর্বরতায় সবাই আতকে উঠেছে। সবার মাথায় এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পরবর্তী শিকার কী আমি?এই আত্নজিজ্ঞাসা যেন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলো বিশ্বজিৎ। ন্যায়বিচারের আশায় ছিলো তার পরিবার কিন্তু অাদৌ কি পেয়েছে ন্যায়বিচার। হত্যাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। আবার কেউবা কর্মক্ষেত্রে দিব্যি চাকরি করে বেড়াচ্ছে। অথচ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নাকি তাদের খুজে পাচ্ছেনা।
সুশীলেরা আজ চুপ।চেতনাধারী অচেতনরা আজ অন্ধ। মানবতাবাদী মুক্তমনারা আজ বোবা। সমাজ ধ্বংস হোক। নারী লাঞ্চিত হোক। শিশু ধর্ষিত হোক। রেল লাইনে কাটা পড়ে মরুক। তবে আমাদের আর কী আসে যায়?
সমাজের প্রতিটি বিবেকবান মানুষই মনে করেন সংঘটিত সকল অপরাধের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত না হওয়ার কারণে সর্বত্রই নৈতিক অধঃপতন স্ফুলিঙ্গের মত বেড়েই চলেছে। ন্যায়বিচার না হওয়ার অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো,সমাজপতিরা এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ক’দিন আগে সোনাগাজীতে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত প্রধান আসামী সিরাজুদ্দৌলাকে রক্ষা করতে থানার ওসি মোয়াজ্জেম কী না করেছে? তিনি তার মনুষ্যত্ব ও বিবেক কে বিক্রি করে দিয়েছে টাকার কাছে। আলহামদুলিল্লাহ সরকার ন্যায় বিচার করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এমনি কত ঘটনা লোক চোখের অন্তরালে সমাজে ঘটেই চলছে তার ইয়ত্তা বা কে রাখে? তারপরও কি বন্ধ হয়েছে ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা! বন্ধ হয়নি কারণ বটগাছকে আমরা এখনো ধরতে পারিনি। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে, সম্প্রতি বরগুনায় রিফাত হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামী নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে এটা জানার সাথে সাথেই সবাই আত্নতৃপ্তির ঢেকুর গিলেছি। কিন্তু আমরা কি বের করতে পেরেছি থলের বিড়ালদের কিংবা আমরা কি বের করার চেষ্টা করেছি?নাকি তাদের ক্ষমতার কাছে হেরে গিয়েছি!যতদিন পর্যন্ত আমরা থলের বিড়ালদের রাস্তায় নামিয়ে ন্যায় বিচার করতে সক্ষম না হই। ততদিন পর্যন্ত সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার সমূলে মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে না। চারদিকে যেনো আজ ধর্ষণের প্রতিযোগিতা চলছে। একটার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটা। দিন দুয়েক আগেই স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।হত্যা করে তার লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল দুই ভবনের মাঝখানে। কি নির্মম আর নিষ্ঠুর মানবতা।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত আমরা ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের লেলিহান শিখা থেকে মুক্তি পাইনি! এ দায় কার?কেনইবা এত বছর পরেও বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে ? কেনইবা সাধারণ মানুষ বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখতে পারেনা? কেনইবা বাবা-মেয়ে লজ্জ্বায় ট্রেনের নিচে আত্বহুতি দেয়? কারণ বিচারকরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও আর্থিক প্রভাবে প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে রায় দিতে পারেনা। প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনা ন্যায়বিচার।
আইন আদালতের কাছে যেতে মানুষ ভয় পায়। কারণ আইন আদালতের মারপ্যাচে অকারণে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মহিলা পরিষদের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ৭৬% নারী কোনো মামলা দায়ের করেনা সর্বস্ব হারানোর ভয়ে
পরিশেষে এটাই বলা যায় যে, দিন শেষে কঠিন থেকে কঠিনতর আইন – প্রয়োগ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই পারে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে।