সেকুলারিজম-আপনাকে ধর্ম চর্চা নিশ্চয়তার সনে আইনের সাপেক্ষে ব্যক্তিক মতাদর্শ ও মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। ড.কামাল হোসেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তাতে চারটি প্রধান মূলনীতির একটি ছিল সেকুলারিজম। বাঙালি মুসলমানের অনেকেই রাজনৈতিক অপব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ জনতার মাঝে সেকুলারিজম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ভুল পথে পর্যুদস্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটি ও জলে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মমতের শান্তিপ্রিয় সহাবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২-এর সংবিধানে সেকুলারিজম শব্দটির সংযোজন করেন। সংবিধান বহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দানের প্রয়াসে সাধারণ জনতার অজনপ্রিয় স্বৈরশাসক এরশাদ ব্যর্থতাকে ঢাকতে ১৯৮৮খ্রিষ্টাব্দে সেকুলারিজমের গায়ে-আমাদের পবিত্র সংবিধানের পোশাকে প্রথম কালিমা লেপ্টে দিয়ে বাঙালির জাতিগত পরিচয়কে করে তোলেন সংকীর্ণ। আমাদের মূল্যবোধকে নিয়ে যান প্রশ্নের কাঠগড়ায়। আমরা মুসলমান ব্যতিত বাকি ধর্ম-গোষ্ঠী ও মতবাদকে বিশুদ্ধতার ছাঁচে তুলি পঙ্কিলতা ঢাকতে। অষ্টম সংশোধনী তাই বাংলাদেশ সংবিধানের একটি অভিশাপ। যা পূর্বের সকল সামরিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দানের অপচেষ্টা।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার রাষ্ট্রে নির্মম চাবুকাঘাত। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ধর্মীয় সহিষ্ণু ও মানবিক সহাবস্থানকে এরশাদ করেছে ভূলুণ্ঠিত। আওয়ামীলীগের ১৯৭২-এর সংবিধানকে যারা অস্বীকার করবে তারা বাঙালি সত্তাকে, বাঙালির ইতিহাস -ঐতিহ্যকে অস্বীকার করবে। আমরা জাতি হিসেবে যতটা বাঙালি-তার সমপরিমাণ সেকুলারিস্ট। আজকের বাঙালিয়ানা সৃষ্টির হাজার বৎসরের পশ্চাতে মুসলমানদের যতটুকু অবদান অনস্বীকার্য, হিন্দু-বৌদ্ধ বা অন্যান্যরাও কোনো অংশ্যে ন্যূন নয়। আমাদের ইতিহাস কেবল মুঘল আর তুর্কীদের নয়; আমাদের ইতিহাস যতটা পাল যুগের- ততটাই সুলতানী আমলের। বরঞ্চ অনেকক্ষেত্রে পাল আমলের ছেদটা বাঙালিত্বকে বেশিপরিমাণে প্রতিনিধিত্ব করে যদিও দক্ষিণ পূর্ব-এশিয় অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও নেগ্রিটোরা বাঙালির আদিপুরুষ। মধ্যযুগের সাহিত্য যতটুকু আমাদের বাঙালিয়ানাকে পরিস্ফুট করে- আধুনিক যুগ তত। এখানে কে বৈষ্ণব ছিলেন, কে বৈশ্য বা কে সাধনতত্ত্ববাদী-তা কখনও মুখ্য নয়। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশকে যতটা প্রতিনিধিত্ব করে ততটাই পাহাড়পুর বিহার বা মহাস্থানগড়ের কীর্তি।
আমরা গৌড়ীয় হতে পারি, হতে পারি হরিকেল বা চন্দ্রদ্বীপ-সমতটের, আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচিয় আমরা বাঙালি। যে বাঙালির অস্থিমজ্জায় আছে সেকুলারিজম, সেই বাঙালি হঠাৎ হিন্দুর হয়ে যাবে তা হতে পারে না। এদেশে হিন্দুর যেমন অধিকার, তেমনটি মুসলমান বা অন্যান্যের। এই বোধ যতদিন আমাদের জাগ্রত হবে না, ততদিন আমরা কানাডার সমান হই আর সিংগাপুরই হই না কেন-আন্তর্জাতিক শান্তি সূচকে ১৯৫টি রাষ্ট্রের শেষদিকেই আমাদের অবস্থান থাকবে। বাঙালি আর সেকুলারিজম তাই একে অন্যের পরিপূরক। সেকুলারিজম সহাবস্থানের মূল্যবোধ আমাদের বলে দেয়- ইহা একটি আদর্শ ও শ্রেয়তর মতবাদ।