চতুর্থ তলার ব্যালকনিতে বসে শায়লা নিচের জনশূন্য রাস্তা, বন্ধ দোকানপাট, মেঘলা আকাশ, ইলেকট্রিকের তারে বসা পাখিগুলো দেখছিল। চারদিকে সুনসান নীরবতা, যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা শহর। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে অনেক কিছু। মা-বাবা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী, দেশ, দেশের মানুষ, গ্রামের বাড়ি, পুকুরপাড়, শীতের সকালে শিশিরভেজা ঘাস, শেফালি ফুল।
হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজে সে বাস্তবে ফেরে। সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। বুকটা কেঁপে ওঠে। কার বাড়ির সামনে গিয়ে যে অ্যাম্বুলেন্সটা থামায়। এ পাড়ার প্রায় সবাইকেই সে মোটামুটি চেনে। না, অ্যাম্বুলেন্স না থামিয়ে সোজা চলে গেছে। কিছুটা স্বস্তি পেল মনে।
এলমহার্স্ট, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের কাছের একটি বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা। বেশ কয়েক বছর শায়লাদের বাস এখানে। মা-বাবা, ভাই-ভাবিদের নিয়ে ভালোই কাটছিল। এখন করোনার তাণ্ডবে সবকিছু তছনছ।
শায়লা এখানের একটি নামকরা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে এবং এখানেই একটি চাকরি করছে, বেশ ভালো বেতনে।
শায়লর বাবা প্রতিবছর এ সময়টায় বাংলাদেশে থাকেন, সামারে আবার এখানে চলে আসেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শায়লার এখন সব চিন্তা বাবাকে নিয়ে। কী করছেন, কেমন আছেন, বাবার অ্যাজমা, ডায়বেটিসের সমস্যা আছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশে ফোন করে বাবার খোঁজখবর নেয়। শায়লা তার বসার চেয়ারটার দিকে তাকাল, এই চেয়ারে বসে বাবা প্রতিদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতেন কখন শায়লা ইউনিভার্সিটি থেকে, কাজ থেকে বাড়ি ফিরবে। চেয়ারটায় বাবার গায়ের একটা ঘ্রাণ খুঁজে পায় শায়লা। বড় ভাইয়া পুরোনো চেয়ার বলে কয়েকবার চেষ্টা করেছে ওটা ফেলে দিতে কিন্তু শায়লার জন্য তা আর হয়ে ওঠেনি।
শায়লার ভালোবাসার মানুষ আনোয়ার। এই আনোয়ারকে নিয়ে তার কত স্বপ্ন। দুই পরিবারের সম্মতিতে আসছে গ্রীষ্মে দুজনের বিয়ে ঠিক। শায়লা মনে মনে ঠিক করে রেখেছে কোন হলে গায়েহলুদ, কোথায় বিয়ে আর কোন ব্যাংকুয়েটে বিবাহোত্তর পার্টি হবে। মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করবে বাংলাদেশে। তবে মধুচন্দ্রিমাটা হবে একটু ব্যতিক্রমী। দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের একটি প্রত্যন্ত এলাকা ভারতের সীমান্তঘেঁষা আগুনঝরা চা-বাগান। সবুজের চাদরে ঢাকা এক জনপদ। সেখানে রয়েছে একটি পোড়া বাংলো। ৩০-এর দশকে সে বাগানের এ বাংলোতে থাকতেন এক ব্রিটিশ ম্যানেজার, গভীর রাতে বাংলোতে আগুন লেগে গেলে নববিবাহিত সেই দম্পতি একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে দুজনই মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন, শরীরের ৭০ শতাংশ ঝলসে যায় কিন্তু তাঁদের ভালোবাসার শক্তি ও টান এত প্রবল ছিল যে দুই বছরের মধ্যেই তারা দুজনেই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। কেন, কীভাবে এ আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, তা আজও রহস্যাবৃত।
বাংলোর অদূরেই রয়েছে একটি গরিব সাঁওতালপল্লি। এদের জীবনযাত্রা দেখে তাঁদের জীবনযাত্রায় আসে পরিবর্তন। এত অল্পতেও মানুষ সুখী হতে পারে! সন্ধ্যার পর তাদের মাদলের আওয়াজে দুজন হয়ে যান মুগ্ধ, বিমোহিত। গভীর রাতে সাঁওতাল যুবকের বাঁশির সুরে তাঁরা হন চমকিত, পুলকিত। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁরা আর ইংল্যান্ড ফিরে যাননি। সাঁওতালপল্লির মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এখানেই একটি স্কুল করে তাঁরা দুজনেই পল্লির বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এখানেই তাঁদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানের বাগান কর্তৃপক্ষ যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই বাংলোটি রেখে দেয়।
স্থানীয় লোকজন এটাকে পোড়া বাংলো নামে জানে। তাঁদের ভালোবাসার স্মৃতি পোড়া বাংলোটি দেখতে প্রেমিক যুগলেরা আজও সেখানে ভিড় জমায়। অনেক দিন আগে শ্রীমঙ্গলের এক সাংবাদিকের মুখে গল্পটি শুনেছিল শায়লা। তখনই সে প্ল্যানটা করেছিল। এই পোড়া বাংলোর আশপাশেই হবে তাদের মধুচন্দ্রিমা যাপন। এদিকে আনোয়ারকে কে নাকি বলেছে, শায়লাদের ওখানে করোনার প্রাদুর্ভাব। তাই সে আর এমুখো হয় না। যে দিনে কম করে হলেও ৪/৫ বার ফোনে কথা বলত, ১০/১২ বার টেক্সট মেসেজ করত, ইদানীং খুব একটা ফোন করে না, শায়লা করলেও ধরে না। শায়লা ভাবে, আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি, অন্তত এ খবরটা নেওয়া তার কর্তব্য ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে নিশ্চয়ই । শায়লা আনোয়ারের এক বন্ধুর কাছে ফোন করে জানতে পারে আনোয়ার ভালোই আছে। খবরটা শুনে আনোয়ারের প্রতি দুর্বলতা থেকে কখন যে একটা বিতৃষ্ণা এবং সেই বিতৃষ্ণা থেকে ঘৃণার ভাব জেগে উঠেছে শায়লার মনে, সে নিজেও তা বুঝে উঠতে পারে না।
ক্লাস, কাজকর্মহীন জীবন মন্দ লাগছে না শায়লার। বইপড়া, টিভি দেখা, মাঝেমধ্যে ভাবিকে কাজে সাহায্য করা আর বিকেলবেলা বাবার চেয়ারে বসে নিচের করোনাকালের জীবনযাত্রা দেখা। শায়লা প্রায়ই লক্ষ করে, তার সামনের ফ্ল্যাটের একটি ছেলে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, বেশ কিছু বক্স গাড়িতে করে নিয়ে যায় আবার ঘণ্টা দুয়েক পর ফিরে আসে। কখনো শায়লার দিকে হাত নাড়ায়। এভাবেই চলছিল। একদিন ছেলেটি নিচ থেকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন আছেন?’ শায়লা বলে, ‘ভালো।’ ছেলেটি বলে, ‘যেকোনো ধরনের সাহায্য লাগলে বলবেন।’ শায়লা বলে, ‘আমরা ঠিক আছি, প্রয়োজন হলে বলব।’ করোনার আপডেট দেখা, কখন লকডাউন শেষ হবে, গভর্নর কী বলছেন, প্রেসিডেন্ট কী করছেন, এসব জানা এখন নতুন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই একেকটা দিন পার হচ্ছে। এক সকালবেলা ১০টার দিকে একটা গল্পের বই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল শায়লা। এমন সময় কল বেলের আওয়াজ। এই অসময়ে আবার কে? এই করোনাকালে কেউ তো কারও বাসায় যায় না। দরজা খুলে দেখে সামনের ফ্ল্যাটের ছেলেটি। শায়লা ভেতরে আসতে বলে। ছেলেটি বলে, ‘না, সোশ্যাল ডিসট্যান্সটা বজায় রাখতে হবে না। আমি এসেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে।’ ‘বলুন।’ ‘না মানে আমি আমাদের কমিউনিটির যাঁদের কাজ নেই, আবার সরকারি কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না, তাঁদের চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে একটু সাহায্য করি, যদি আপনারা আমার সঙ্গে আসেন বা সাহায্য করেন, তবে ভালো হয়। ছেলেটির কথা শাহানার খুব মনে ধরল। শাহানা ভাবল, এ অবসরে অসহায় মানুষের জন্য কিছু করলে তো ভালোই হয়। সে ছেলেটিকে ২০০ ডলার দিল এবং বলল, ‘প্রয়োজনে আমাকে বলবেন।’ ছেলেটি ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যাচ্ছিল। শায়লা বলল, ‘নামটা কিন্তু জানা হলো না।’ ছেলেটি বলল, ‘আমি শাহেদ।’ শাহেদ সিঁড়ির রেলিং ধরে নিচের দিকে যাচ্ছে আর শায়লা তার পেছন দিকে তাকিয়ে আছে যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। শাহেদ চলে যাওয়ার পর শায়লা ভাবে, এই নিউইয়র্ক নগরীতে অনেক অবৈধ বাঙালি রয়েছেন যাঁরা এত দিন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন। এখন তো তাঁদের কাজ নেই। কাজ নেই তো বেতনও নেই। এঁরা না পাবেন রাজ্যের বেকারভাতা, না পাবেন সরকারি অনুদান। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অসহায় এঁরা। তাঁদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ।
বড় ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করে পরদিন শাহেদের সঙ্গে কথা বলে শায়লাও নেমে পড়ে ত্রাণকাজে। ফেসবুকের মাধ্যমে তারা অবৈধ বাংলাদেশিদের আহ্বান করে যেন তাঁদের বাড়ির নম্বরটা টেক্সট মেসেজ করেন। তাহলে তারা খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেবে।
দুদিনের মধ্যে খবরটি পুরো কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেন। শায়লা আর শাহেদ দুটি গাড়িতে করে সকাল-বিকেল খাদ্যদ্রব্যসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেয়। এভাবেই চলছে গত কদিন। তাদের এই কর্মকাণ্ডের খবর স্থানীয় একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। শাহেদের কর্মস্পৃহা, লড়াকু মানসিকতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, উদারতা, আন্তরিকতা, নিরলস প্রচেষ্টা, কর্তব্যজ্ঞান আর দায়িত্ববোধ দেখে শায়লা মুগ্ধ। প্রতিদিনই এখন ফোনে কথা হয় শাহেদের সঙ্গে। থমকে যাওয়া এ সময়ে শাহেদ নতুন এক ভোরের স্বপ্ন দেখায়। করোনাকালের এই সময়ে মৃত্যুর কোল থেকে জীবনের মাঝখানে সেতু গড়ার চেষ্টা করে। সুন্দরকে নিজের মধ্যে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে, সর্বজনীনতার কথা বলে, সম্ভাবনার কথা বলে, সুন্দর এক পৃথিবীর গল্প বলে।
শায়লা শাহেদকে যত দেখে, যত জানে, যত বোঝে, ততই তার প্রতি দুর্বল হতে থাকে। শাহেদকে তার মনে হতে থাকে ‘সব পেয়েছির ঘর’। শায়লা ভাবে, কয়েক দিন আগের চেনা মুখগুলো কেমন অচেনা হয়ে গেল; অন্যদিকে অচেনা, অদেখা মানুষটা কেমন আপন হয়ে গেল।
সকালে শাহেদ আর শায়লা কিছু ত্রাণ বণ্টন করে এসেছে। আজ কেন জানি শায়লার মনটা খুব ফুরফুরে। দুপুরের খাওয়া শেষে একটা ভাতঘুম দিয়ে বিকেলে ব্যালকনিতে বাবার চেয়ারটাতে বসে নিচের কর্মহীন অলস বিকেল দেখছিল। কেমন যেন একটু তন্দ্রাভাব চলে এসেছে, শায়লা দেখছে, বাংলাদেশগামী বিমানে পাশাপাশি বসা শাহেদের হাত ধরে শায়লা জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে, খুব কাছ থেকে মেঘ দেখছে। আগুনঝরা চা-বাগানের সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে দুজন হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সেই পোড়া বাংলোর দিকে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। বিশুদ্ধ অক্সিজেন। মাঝেমধ্যে পাখিদের ওড়াওড়ি। গাছের ডালে বসে আছে দুটো বাচ্চা নিয়ে মমতাময়ী মা বানর। তির তির করে ছোট্ট একটা পাহাড়ি ছড়া বয়ে চলেছে, কি স্বচ্ছ তার পানি। সেই পানিতে ভেসে যাচ্ছে পাহাড়ি ফুল। মাঝেমধ্যে গাছগাছালির ডালপালা, লতাপাতা ভেদ করে আসছে সূর্যের আলো। ওই যে দেখা যাচ্ছে সাঁওতালপল্লি। পোড়া বাংলার সামনে বিরাট একটি ভাস্কর্য। এক যুবতী জড়িয়ে ধরে রয়েছে এক যুবককে। যেন যুগ যুগ ধরে ধরে রাখা, ধরে থাকা। ভালোবাসার এক আত্মিক বন্ধন। হঠাৎ সেল ফোনের রিং টোনে সংবিৎ ফিরে পায় শায়লা। শায়লা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সেল ফোনের স্ক্রিনজুড়ে শাহেদ। শুধুই শাহেদ। শাহেদের ফোন। অজানা এক আনন্দের স্রোতে তার সারা শরীরে খেলা করছে এক গোলাপি আভা। আর সেই আভা যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের এলমহার্স্ট থেকে আগুনঝরা চা-বাগানের সেই পোড়া বাংলায় ।