আমাদের নিউইয়র্ক শহরে এখন বসন্তের হিমেল হাওয়া। ম্যাগনোলিয়ার পাপড়ি ঝরে পড়ছে প্রতিদিনই শব্দহীন। চেরি এখনো ফোটেনি। প্রস্তুতি নিচ্ছে। টিউলিপ এপ্রিলের শেষ দিকে রং ছড়াবে শুনেছি। জ্যাকসন হাইটস, ডাইভারসিটি প্লাজায় শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সেভেন্টি ফোর স্ট্রিটে ভুতুড়ে নির্জনতা। জ্যাকসন ডায়নারে মধ্যাহ্নভোজের দীর্ঘ লাইন নেই।
ফুলের মিষ্টি সুবাস আর সৌন্দর্যের হাতছানি উপেক্ষা করে চার দেয়ালের মধ্যে স্বেচ্ছাকারাবাস আমাদের। অচেনা আগন্তুকের মতোই মৃত্যুদূতের আনাগোনা চারপাশে। আমরা জানালায় উঁকি দিয়ে অচেনা বাতাসে ভেসে বেড়ানো আগন্তুক দেখি। আমরা বেঁচে থাকার আশায় ভালো থাকি রোজ!
বেঁচে থাকার আশায় আমাদের খাবার খেতে হয় রোজ। সঞ্চিত খাবার ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। বাচ্চাদের দুধ, ডিম, কলা, পাউরুটি ফুরিয়েছে অনেক আগেই। এসব এখন আমাদের কাছে বিলাসী খাবার। কোনোমতে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। আর্থিক সংকটের বিষয় নয়, বরং বাইরে বেরোনোটাই বিরাট চ্যালেঞ্জ। কেননা, নগরীতে হুহু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
আমেরিকার নিউইয়র্কের কুইন্স, অর্থাৎ যে এলাকায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার, সেখানেই সপরিবার আমাদের বসবাস। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এবং বারবার করে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে সবাইকে বাড়িতে অবস্থান করতে। তবু প্রয়োজনীয় ওষুধ ফুরিয়ে গেলে নিরুপায় হয়ে বের হতে হচ্ছে। ফার্মেসিগুলো সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলছে। তারা ক্রেতাদের ক্যাশ কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য ছয় ফুট দূরত্বে মার্ক করে দিয়েছে। গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ান গ্রোসারিতে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। বিশাল বড় স্টোর, অথচ ভেতরে খুব কমসংখ্যক ক্রেতা। বাইরে ক্রেতাদের বিশাল লাইন। কিছু ক্রেতা বেরিয়ে এলেই তবে কিছুসংখ্যক ক্রেতাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কাজ সেরে গিয়েছিলাম অন্য আরেকটি সুপার শপে। একজন মাত্র ক্যাশিয়ার কাজ করছে ক্যাশ কাউন্টারে। ক্রেতা এবং ক্যাশ রেজিস্টারের মাঝ বরাবর লম্বা কাচের পার্টিশন দেওয়া হয়েছে সতর্কতাস্বরূপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্যাশিয়ার সংকট। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কেউ কাজে যেতে চাইছে না। কিছু জিনিস ট্রলিতে নিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য হাঁটছি বিশালাকৃতির স্টোরের প্রশস্ত আইলের ভেতর দিয়ে। লাইনটি দীর্ঘ হতে হতে এক আইল থেকে অন্য আইলে সাপের মতো এঁকেবেঁকে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, সেই শেষ প্রান্তের দেখা পাইনি। অগত্যা জিনিস রেখেই বেরিয়ে এসেছি।
দীর্ঘ শীত শেষে বছরের এই সময়টায় শিশুরা পার্কে ছোটাছুটি খেলার কথা। বন্ধ ঘরে দিনের পর দিন সময় কাটানো তাদের জন্য কঠিন এক পরীক্ষা! বসন্তের এই সময়ে বাইরে ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া। সঙ্গে মাতাল হাওয়া। বসন্ত কি খুব একাকী নৈঃশব্দ্যের মধ্যে বিষণ্ন মনে ফিরে যাবে এবার? শহরজুড়ে হবে না কোনো বসন্ত উৎসব কিংবা বৈশাখবরণের আয়োজন? হবে না শিকড় ছেড়ে স্থানান্তরিত হওয়া মানুষের সমাগম? না হয় থাকুক এবার সব আয়োজন। তবু থামুক মৃত্যুর মিছিল। থামুক ঘরে ঘরে স্বজন, প্রিয়জন হারানোর শোক। থামুক এক ফোঁটা অক্সিজেন পাওয়ার বিরামহীন যুদ্ধ। কোলাহলমুখর এই শহরটা সত্যিই আজ নৈঃশব্দ্যের শহর হয়ে উঠেছে। শুধু থেমে থেমে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে ওঠে করুণভাবে। আমরা বেঁচে থাকা মানুষেরা আচমকা সেই সব শব্দে কেঁপে পেঁপে উঠি অজানা শঙ্কায়।
আমাদের এবারের বসন্তকালীন সন্ধ্যাগুলো বড় বেশি বিবর্ণ, ম্লান। আমাদের চোখ মেলে দেখা হয় না ফুলের ভারে নিচু হয়ে আসা ম্যাগনোলিয়ার ডাল আর সবুজ ঘাসের মাঝে গড়ে ওঠা নিবিড় সম্পর্ক। আমরা ভুলে যাই এখন ভোর না সন্ধ্যা। ভুলে যাই বুধবার না বৃহস্পতিবার। প্রতিটি মধ্যাহ্ন কিংবা অপরাহ্ণকে মনে হয় অভিশপ্ত। জীবন এত দিন ছিল আদিগন্ত খোলা মাঠের মতো। এখন তুমুল বৃষ্টিতে চুপচুপে ভেজা আশ্রয়হীন দাঁড়কাকের মতো। তবু জীবনের নিষ্ঠুর সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা জীবন খুঁজি।