তারপরে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আউলিয়া কামেলীন, বুজু্র্গানে দ্বীনের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার ও প্রসার হয়।আর ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে রাজা, বাদশাহ,সুফি সাধক আউলিয়ে কেরামদের মাধ্যমে ইসলামের পতাকা উড্ডয়ন হয়।আর তাদের মধ্যে অন্যতম কুতুবুল আউলিয়া হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহঃ)।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেন ৩৮ তম বংশধর হযরত সৈয়দ সদর শাহ (রহ:) এর ৪র্থ পুত্র হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ(রহঃ) উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ১৮৫২ সালে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জেলার সিরিকোট গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
তার পূ্র্ব পুরুষ হযরত সৈয়দ গফুর শাহ প্রকাশ কাপুর শাহ সর্ব প্রথম দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে বর্তমান পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের সিরিকোট অঞ্চলে আসেন এবং বিজয় ও আবাদ করেন।এই জন্য তাকে ফাতিহে সিরিকোট বা সিরিকোটের বিজেতা বলা হয়।(সূত্র:-Local Govt. Act, Ref 15 Hazara 1871,Pakistan)
তিনি অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআন মাজিদ হিফজ করেন। পরবর্তীতে নাহু,সরফ,বালাগাত,মানতিক,উসুলে ফিকহ, উসুলে হাদিস,তাফসির,হাদিস, কুরআন,তাসাউফ, মারফত,ত্বরীকত সহ নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
তার পবিত্র জীবন ছিল সুন্নাতে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাস্তব প্রতিচ্ছবি। যা তার কর্মে অনায়াসে ফুটে উঠে।তিনি সহোদরদের সাথে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকাতে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন ও প্রতিষ্ঠিত হন। একই সাথে আফ্রিকার ক্যাপাটাউন,জাঞ্জিরা ও মোমবাসা শহরে সেখানকার জনগনের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং ইরান থেকে আগত শিয়াদের কবল থেকে মুসলামদের ইমান,আমল হেফাযত করেন।
বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায় তিনিই সেখানে সর্বপ্রথম ১৯১১ সালে মসজিদ নিমার্ণ করেন ।( সূত্র:-A History of muslims in South Africa By -Dr.Ibrahim M Madi)
ইসলামি শরীয়তের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ও নিজেকে একজন ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ সার্থক মানুষ হিসেবে মনে করতে পারছেন না।এই জন্য প্রখ্যাত সুফি সাধক আল্লামা জালালউদ্দিন রুমী( রহ:) বলেন “খোদ বখোদ কামেল নশুদ মোল্লায়ে রোম তা গোলামে শমছে তিবরিযী নশুদ”।অর্থাৎ আমার মুরশিদে কামেল শমছে তিবরিযীর গোলামী না করা পর্যন্ত আমি (মাওলানা রুমী)পূর্ণতা অর্জন করতে পারিনি। এই জন্য তিনি একজন কামেল পীরের সন্ধানে ব্রতী হন।অত:পর পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের হরিপুর চৌহর শরীফের এক প্রসিদ্ধ বুজু্র্গ মা’আরেফে লুদুনিয়্যার অধিকারী হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভীর (রহ:) নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। তিনি একজন সৈয়দ, যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন ও হাফেজে কুরআন হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় মুরশিদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অনেক বছর দুগম পথ পাড়ি দিয়ে গভীর অরণ্য ১৮ মাইল দূর হতে জ্বালানী কাঠ নিজের মাথায় বহন করে পীরের বাড়িতে লঙ্গরখানার জন্য নিয়ে আসতেন। স্বীয় মুরশিদের তত্ত্বাবধানে জাহের বাতেনে পূর্নতা অর্জন করেন।ইবাদত বন্দেগী,জিকির আযকার,মোরাকাবা,মোশাহাদা,রিয়াজতের মাধ্যমে ত্বরীকতের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করেন।পরিশেষে হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী (রহ:) তাকে খিলাফতের মহান দায়িত্ব অর্পণ করেন।
১৯২০ সালে হযরত চৌহরভী (রহ:) নির্দেশে ইসলামের আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের চৌহর থেকে সুদূর রেঙ্গুনে ষোল বছর কঠোর পরিশ্রম সাধনা ও মানবসেবায় অতিবাহিত করেন।তিনি বার্মার বাঙ্গালী মসজিদের প্রধান খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।১৯২৫ সালে বার্মায় সর্বপ্রথম আঞ্জুমানে -এ শুরায়ে রহমানিয়া নামে একটি দ্বীনি সংস্হা কায়েম করেন। যা ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া নামে নাম করন করা হয়। হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী (রহ:) এর একান্ত ইচ্ছাতে ১৯০২ সালে পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠান ৪০ বছর পরিচালনা করেন।
ইলমে লাদুনীর ধারক হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী রহ(রহ:) কর্তৃক রচিত মুহাযিরুল উকূল ফী বায়ানি আওসাফি আকলিল উকূল বা সংক্ষেপে মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে বাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করে সুদূর রেঙ্গুনে ১৯৩৩ সালে সর্বপ্রথম ছাপানোর কাজ সমাপ্ত করেন।৩০ পারা কুরআন মাজিদ এবং ৩০ পারা বুখারী শরীফের পর এইটিই ৩০ পারা দুরুদ শরীফের কিতাব।এই কিতাবের ৩০ পারার প্রতি পারাতে ৪৮ পৃষ্ঠা করে সর্বমোট ১৪৪০ পৃষ্ঠা রয়েছে। উক্ত কিতাব খানাতে ৬৬৬৬ টি দুরুদ শরীফ রয়েছে।প্রতিটি দুরুদ শরীফে শানে মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে র শেষের দিকে চট্রগ্রামের মুরীদদের সাথে চিরতরে বার্মা ত্যাগ করেন।বার্মা ফেরত এবং চট্রগ্রামের মুরীদদের অনুরোধে ১৯৪২ সালে বাংলাদেশে আসেন। তার আগেও বার্মা আসা -যাওয়ার সময় চট্রগ্রাম বন্দরে নেমে ২/১দিন আব্দুল খালেক ইইঞ্জিনিয়ারের বাসায় অবস্হা করতেন।১৯৪২ সাল হতে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শীতকালীন সময়ে হুজুরকে চট্রগ্রামে আনা হত। এসময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ, নসিহত সহ সিলসিলার কার্যক্রম করতেন। এরুপ ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে মাওলানা এজহার সাহেবের অনুরোধে চট্রগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখীল নামক গ্রামে মাহফিলে গেলে ত্বাকরীরের প্রারম্ভে কুরআনে কারীমের আয়াত “ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইয়ু সাল্লুনা আলান নাবিয়্যী ইয়া আইয়ুহাল্লাযিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা পাঠ করে এই উদ্দেশ্যে যে সকলকে নিয়ে নবীজীর উপর দুরুদ-সালাম পড়বেন।কিন্তু বিপরীত ঘটনা হল কেউ হুজুর কেবলার সাথে পড়লেন না। এতে হুজুর কেবলা রাগ্বানিত ও মর্মাহত হলেন।তারপরে সকল মুরীদদেরকে ডাকলেন মাদ্রাসা করার জন্য এবং মাদ্রাসা জন্য জায়গাও দেখতে বললেন, মাদ্রাসার পরিবেশ কেমন হবে তার বর্ণনা দিয়ে বলেন “এয়সা জাগাহ চাহিয়ে, জো গাঁওভী নেহী, শহর সে দূরভী নেহি,মাসজিদ ভী হে, তালাব ভী হে, আনে জানে মে তাকলীফ না হো “। পরে সে স্হানটি নির্ধারিত হয় চট্রগ্রামের ষোলশহরের নাজিরপাড়ায়। পরে ১৯৫৪ সালের নির্ধারিত স্হানে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া অালিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। হুজুর কেবলা সিরিকোটি (রহ:) জামেয়া সর্ম্পকে বলেন -“ইয়ে জামেয়া কিস্তিয়ে নূহ হ্যায় “। নিজ মুরীদদেরকে লক্ষ্য করে বলেন -মুঝেহ দ্যাখ্না হ্যায় তো মাদ্রাসা কো দ্যাখো,মুঝসে মুহাব্বহত হ্যায় তো মাদ্রাসা(জামেয়া) কো মুহাব্বত করো। হুজুর কেবলার ভক্ত -অনুরক্তরা এ নির্দেশ যথাযথ ভাবে পালন করছেন।জামেয়ার প্রতি ভালবাসা -মুহাব্বত সিরিকোটি হুজুর ( রহ:) এর প্রতি মুহাব্বতের নামান্তর। যা দ্বীনের আলোর মত সু-স্পষ্ট। জামেয়ার বাগানের ফুলেরা আজো দুশমনে রাসুলদের মোকাবিলায় কালজয়ী ভূমিকা রাখছে।জামেয়া বাংলার সুন্নীয়তের মারকাজ।
সিরিকোটি হুজুর কেবলা (রহ:) হাতে প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে দেশে শত শত মাসজিদ, মাদরাসা, খানকা পরিচালিত হচ্ছে। আর আঞ্জুমানের একমাত্র অঙ্গসংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের কর্মীরা সর্বদা নিয়োজিত থাকেন। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত করোনা মহামারিতে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সকলের লাশ দাফন কাফনের ব্যবস্থা গ্রহণ মৃত্যু বরণ কারীর ধর্ম অনুযায়ী। অাঞ্জুমান, গাউসিয়া কমিটি সিরিকোটি হুজুর কেবলা (রহ:) পক্ষ হতে আমাদের জন্য বিশেষ নিয়ামত।
হুজুর কেবলা শাহেনশাহে সিরিকোটি (রহ:) ১৯৪৫ সালে এবং ১৯৫৮ সালে জাহাজযোগে হজ্ব পালন করেন।।এই সময়ে মদীনা মুনাওয়ারা , সাহাবায়ে কেরামদের মাজার সহ গুরুত্ববহ স্হান যিয়ারত করেন।
হুজুর কেবলা সিরিকোটি (রহ:) সর্ম্পকে আল্লামা গাজী শেরে বাংলা( রহ:) বলেন -” দর যামানশ নবী নম্ মিসল ঊ পীরে মগাঁ অর্থাৎ -ঐ যমানায় তার (সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রহ:) তুলনা হয় এমন উঁচু স্তরের পীর আমি কোথাও দেখেনি।(সূত্র :- দীওয়ানে আযীয কৃত আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহ:, হাটহাজারী, চট্রগ্রাম)
এই মহান অলীয়ে কামেল দ্বীন মাজহাব মিল্লাতের বৃহত্তম খেদমত আঞ্জাম দিয়ে প্রায় ১০৯ বছর পবিত্র জীবন লাভে ধন্য হয়ে ১৩৮০ হিজরির ১১ ই জিলক্বদ মুতাবিক ২৫ শে মে ১৯৬১ ইংরেজি রোজ বৃহস্পতিবার ইহ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান (ইন্নাল্লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)।
তথ্যসূত্র:-**Local Govt. Act, Ref-15 Hazara 1871,Pakistan
**A History of muslims in South Africa By-Dr. Ibrahim M Madi
** শাজরা শরীফ -দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া ।
**সুন্নীয়তের পঞ্চরত্ন কৃত অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম রিজভী মা:জি:আ:
**সিরিকোট থেকে রেঙ্গুন কৃত অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার
**উইকিপিডিয়া
লেখক/ দোয়া কামনায়ঃ
মুহাম্মদ মাছুম বিল্লাহ
আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্ট্যাজিজ
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, ষোলশহর,চট্রগ্রাম।