নামাজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। স্রষ্টার সাথে আশরাফুল মাখলুখাত মানুষের সম্পর্কের অন্যতম মাধ্যম নামাজ। নামাজ প্রভু ও বান্দার মাঝে এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন। প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলমান নর-নারীর ওপর নামাজ ফরয।
প্রত্যেকেই নামাজ পড়েন কিন্তু যথাযথ গুরুত্ব দেন না। যার কারণে পরিপূর্ণভাবে নামাজ আদায় হয় না, আবার সাওয়াবও কমে যায়। এমনকি কোন কোন সময় পুনরায় আদায় করতে হয়। এই ধরনের নামাজ দ্বিতীয়বার আদায় না করলে অবশ্যই গুনাহগার হবে। তাই আমাদের নামাজ আদায় করতে হবে পূর্ণাঙ্গ মুহাব্বত, সর্বোচ্চ বিনয় ও পরম ভয়ের সাথে।
বান্দা যখন তাকবীরে তাহরীমা দ্বারা দুনিয়াবী কাজ থেকে বিরত হয়ে কান ধরে একাগ্রচিত্তে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় তখন সে আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়। তার সূরা ফাতিহা ও ক্বিরাত পড়া হলো আল্লাহর সাথে কথপোকথন, সে সিজদা করে আল্লাহর কুদরতী কদমে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ان الساجد يسجد فى قدمى الرحمن
নিশ্চয় সিজদাকারী আল্লাহর কুদরতী কদম মোবারকেই সিজদা করে।
নামাজ মুমিনের মিরাজ। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- الصلاة معراج المؤمنين – নামাজ মুমিনের মিরাজ।
এ জন্য নামাজে পাক-পবিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করতে হয়, আতর খুশবু লাগাতে হয়। ইমাম তাবারানী “আওসাত” নামক গ্রন্থে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মত পড়ে এবং উক্ত নামাজের ওযু, ক্বিয়াম, খুশু, রুকু ও সাজদা সম্পূর্ণরূপে আদায় করে সে নামাজ সাদা ধবধবে(উজ্জ্বল) আলোকিত হয়ে এই বলে বের হয়- আল্লাহ তোমায় হিফাযত করুক, যেভাবে তুমি নামাজ হিফাযত করেছো। আর যে ব্যক্তি সময়মত নামাজ পড়েনা আর ওযু, কিয়াম, খুশু, রুকু ও সাজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না সেই নামাজ কালো অন্ধকার হয়ে এই বলে বের হয় যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাকে ধ্বংস করুক যেভাবে তুমি আমাকে নষ্ট করেছো। শেষ পর্যন্ত সেই জায়গায় গিয়ে পৌঁছে যেখান পর্যন্ত আল্লাহ তা’য়ালা ইচ্ছা করেন, অতঃপর পুরানো আবর্জনার মত একত্রিত করে তার মুখে নিক্ষেপ করা হয়।
[আবুল কাসিম সুলায়মান তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, কায়রো, দারুল হারামাইন, খন্ড-৩, পৃ-২৬৩, হাদীস নং ৩০৯৫; ফাতাওয়া রিদভিয়্যা, খন্ড-২, পৃ-৩১৫।]
বান্দা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন সে মূলত আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে দাঁড়ায়। তাই বান্দা যখন নামাজে দণ্ডায়মান হয় সে যেন আল্লাহকে দেখে। আর যদি দেখা সম্ভব না হয় তাহলে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে দেখছেন। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ان العبد اذا قام الى الصلاة فانما هو بين يدى الرحمن فاذا التفت يقول الله عز و جل الى من تلتقت الى خير منى اقبل يا ابن ادم فانا خير ممن تلتفت اليه
অর্থাৎ বান্দা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন সে মূলত আল্লাহ তায়ালার একেবারে সম্মুখে দাঁড়ায়। অতএব মুসল্লি যখন নামাজে আল্লাহর ধ্যান বাদ দিয়ে অন্য কোন দিকে মনোযোগী হয়ে পড়ে তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে লক্ষ্য করে বলতে থাকেন- তুমি কি আমার চেয়ে উত্তম কিছুর দিকে মনোযোগী হচ্ছ? হে আদম সন্তান! তুমি আমার দিকে মনোযোগী হও। কারণ তুমি যেদিকে মনোযোাগী হচ্ছ আমি তার চেয়ে অধিক উত্তম।
হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
العبد اذا قام الى الصلاة فتحت له ابواب السماء وكشفت له الحجب بينه وبين ربه تعالى
অর্থাৎ বান্দা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং ঐ নামাজী বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার পর্দা তুলে নেওয়া হয়। (ফলে বান্দা অন্তর চোখে আল্লাহর নূরানী দর্শনে বিভোর হয়ে পড়ে)।
নামাজের মাসয়ালা-মাসায়িল সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে পরিপূর্ণ মুহাব্বত, বিনয় ও ভয়ের সাথে আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করতে হবে। তখনই নামাজ আমাদের জন্য মি’রাজ হবে। নতুবা সেই নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। যেমন একটি হেকায়েত/ঘটনা রয়েছে- হযরত আ’তা সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু খুবই ভালভাবে বুনন করে একটি কাপড় তৈরি করেন। এটা খুব চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন কাপড় তৈরি হলো। তিনি এ কাপড়খানা বিক্রয়ের জন্য বাজারে যান এবং এক কাপড় ব্যবসায়ীকে তা দেখান। কাপড় ব্যবসায়ী কাপড়টির মূল্য অত্যন্ত কম নির্ধারণ করে মন্তব্য করেন যে, এ কাপড়ে অমুক অমুক ত্রুটি রয়েছে, সুতরাং এ কাপড়ের পূর্ণ মূল্য পাওয়া যাবে না। হযরত আ’তা সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সে কাপড় সেই ব্যবসায়ী থেকে নিয়ে নিলেন এবং কাঁদতে লাগলেন, অনেক কাঁদলেন। এ অবস্থা দেখে কাপড় ব্যবসায়ী খুব লজ্জিত হলেন এবং তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে প্রার্থিত প্রত্যাশিত মূল্যে কাপড়টি কিনতে রাযি হন। লোকটির এ অবস্থা দেখে হযরত আ’তা সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন অমি কাপড়ের মূল্য কম হওয়ার কারণে কাঁদছি না; বরং আমার কান্নার প্রকৃত কারণ হলো আমি একজন পারদর্শী বুনন শিল্পী হিসাবে এ কাপড়খানা টেকসই সুন্দর ও সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে অনেক চেষ্টা করেছি, এমনকি আমার জানামতে এতে কোন ধরনের খুঁত ছিলো না। কিন্তু যখন এ কাপড় একজন অভিজ্ঞ বুনন শিল্পীর সামনে উপস্থাপন করা হলো তখন তিনি কাপড়টিতে এমন কিছু ত্রুটি ও খুঁত বের করলেন, যেগুলো সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম না। সুতরাং আমাদের ঐ সকল নামাজ, আমলের কি অবস্থা হবে কাল কিয়ামতে যখন সেগুলো খোদা তা’আলার সমীপে উপস্থাপিত হবে। জানা নেই আমাদের সেসব আমলে কত দোষ-ত্রুটি ও খুঁত প্রকাশ পাবে যেগুলো সম্পর্কে আজ আমরা অনবহিত।
প্রিয় পাঠক, উল্লেখিত আলোচনা ও ঘটনাটি গভীরভাবে উপলব্দি ও চিন্তা করুন। আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক সুন্নী মুসলমানকে ঈমানের নিরাপত্তা ও বিশুদ্ধতার পাশাপাশি নিয়মিত সঠিকভাবে নামাজ আদায়ের তাওফীক দান করুক। আমিন
তথ্যসূত্র :
১। আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (রহ.) (৯১১ হি.), জামেউস সগীর।
২। তাফসীরে রুহুল বয়ান, খন্ড-৬, পৃ-৪৫;
তাফসীরে নিশাপুরী, খন্ড-১, পৃ-৫৩;
তাফসীরে হক্কী, খন্ড-৮, পৃ-৪৫৩।
৩। আবুল কাসিম সুলায়মান তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, কায়রো, দারুল হারামাইন, খন্ড-৩, পৃ-২৬৩, হাদীস নং ৩০৯৫; ফাতাওয়া রিদভিয়্যা, খন্ড-২, পৃ-৩১৫।
৪। মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সোলায়মান আল হাছানী, নামাযের হাকিকত; পৃষ্ঠা-৩৩।
৫। মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সোলায়মান আল হাছানী, হাযাযের হাকিকত, পৃ-৩২।
৬। মিনহাজুল আবেদীন, পৃ-২৯৭।
কৃতজ্ঞতায় : মুহাম্মদ মাছুম বিল্লাহ
আল-হাদিস এণ্ড ইসলামিক স্ট্যাডিজ(দ্বিতীয় বর্ষ)
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া,
ষোলশহর, চট্টগ্রাম।