এদ্দিন আমরা মৃত্যুকেই চূড়ান্ত লেভেলের বা পরম সমতাসাধক বলে জানতাম। কারণ মৃত্যুই একমাত্র অন্ত্যদশা, যে নিদান মানুষে মানুষে সকল ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেয়। বংশ বর্ণ গোত্র ধর্ম দৌলত বিত্ত পদবি মর্যাদা মহিমা ও শ্রেণি-পেশার তারতম্য নির্বিশেষে সকলকে এক কাতারে দাঁড় করায়। আশরাফ-আতরাফ, ধনি-নির্ধন, রাজা-প্রজা, বাদশাহ-পেয়াদা, উজির-চাপরাশি, আমলা-কেরানি, জ্ঞানি-মূর্খ, বীর-ভীতু, উচ্চ-তুচ্ছ, গণ্য-নগণ্য সকল মৃত মানুষের একটাই নাম– ‘লাশ’’। ভাষা-পরিভাষার ভিন্নতায় সেই ‘লাশ’ই শবদেহ, মরদেহ, মৃতদেহ, মড়া, মাইয়াত, ডেডবডি কিংবা আরো সংক্ষেপে শুধু ‘বডি’। মৃতদেহ সৎকারে প্রকৃতিগত তারতম্য থাকলেও এর সর্বশেষ গন্তব্য মাটি। মাধ্যম শ্মশান কিংবা গোর। প্রতিটা মানুষই জানে যে, ‘কতো পুরাতন পাতার মতন আমিওতো একদিন/ এই ধরণির ধূলায় ঝরিয়া একদা হবো বিলীন।’ কিংবা, ‘একদিন আমিওতো শুকনো পাতার মতো মাটিতেই বিলীন হবো/ ধুলোর অঙ্গ হয়ে ধুলোতেই মিশে রবো।’ তাই মানুষের জন্য মাটিও প্রকারান্তরে লেভেলার। মাটিতেই মানব দেহের সৃষ্টি, স্থিতি আর লয়। সে অর্থেই মাটি ও মানুষ সমার্থক।
কিন্তু সপ্রতি লেভেলের হিসেবে যুক্ত হয়েছে ‘নভেল করোনা’ নামে পরিচিত কোভিড–১৯’ ভাইরাসটিও। বর্তমান শতাব্দির বৃহত্তর বৈশ্বিক সংকট এটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত ও স্বীকৃতি ‘বৈশ্বিক মহামারী’। বিল গেটস করোনা-কে বলেছেন ‘গ্রেট লেভেলার। কেননা এটা সকল মানুষকে শ্রেণি-পেশা, ধন-মান,পদ-পদবি নির্বিশেষে সমহারে আক্রান্ত করছে। ন্যায্য কথাই বলেছেন গেটস। আক্রান্তের তালিকা দেখেতো সে উক্তির যথার্থতাই ফুটে উঠে। এ রোগে বিশ্বব্যাপি ৩ মিলিওনেরও বেশি সাধারণ মানুষ যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি আক্রান্ত হয়েছেন পৃথিবীর ডজন ডজন অতি গুরুত্বপূর্ণ নামি-দামি বিশেষ ব্যক্তিত্ব। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও মারা যাওয়াদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আছেন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মন্ত্রী–এমপিরা। আছেন নামি–দামি অভিনেতা–অভিনেত্রীরাও। এর সংক্রমণ থেকে বাদ যাচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, ফার্স্ট লেডি, রাজপুত্র, রাজা-রাণী, ধনকুবের, স্বনামধন্য নেতা অভিনেতা কেউই। ইতোমধ্যে, আক্রান্ত হয়েছেন প্রিন্স চার্লস, বরিস জনসন, অভিনেতা টম হ্যাংকস, রিটা উইলসন, ব্রিটিশ অভিনেতা ইদ্রিস এলবো, অ্যাথলেট নরম্যান হান্ট, জেসন কলিন্স প্রমুখ।
বিশ্ব নেতাদের মধ্যে আরও আক্রান্ত, হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ,মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল ,কানাডার ফার্স্ট লেডি, ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্পেনের রাণি ও এক মন্ত্রী। তাছাড়া তালিকায় আক্রান্তের আছেন, যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, একজন এমপি, ইতালির ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা, ফ্রান্সের সংস্কৃতিমন্ত্রী, রিপাবলিকান দলের পাঁচজন এমপি। ইরানের ৭ শতাংশ আইনপ্রণেতা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার একটি মন্ত্রণালয়েই (সমুদ্র ও মৎস মন্ত্রণালয়) আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ জন কর্মী। বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও আক্রান্ত হয়েছেন অস্কারজয়ী মার্কিন অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস এবং তার স্ত্রী রিটা উইলসন। আক্রান্ত হয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর– যিনি এই ভাইরাসকে সম্প্রতি ‘ফ্যান্টাসি’ বলে মশকরা করেছিলেন। একই দিনে ভাইরাসটি ধরা পড়ে অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শরীরেও। এ হচ্ছে করোনা দ্য লেভেলার-এর খণ্ডচিত্র।
এ ভাইরাস সংগনিরোধের নামে একদিকে মানুষকে বিযুক্ত করেছে, অন্যদিকে সংক্রমণ ও অকাল মৃত্যুর মিছিলে মানুষকে যুক্ত করছে নিত্যদিন। এর গতি এখনো অপ্রতিরোধ্য, লাগামহীন। এর সংক্রমণ বিস্তারে আদৌ নেই কোন বাছবিচার। নেই কোনো সম্মান-সমীহ। নেই ভয়-শংকা। পুরো ডেম কেয়ার। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান থেকে উৎপত্তির পড় থেকে ইতালি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন থেকে শুরু করে ইতোমধ্যেই বিশ্বের ২১৩টি রাষ্ট্রে সংক্রমিত হয়েছে। এযাবৎ সংক্রমিত করেছে সাড়ে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষকে। বিশ্বব্যাপী প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের। এর ভয়াল থাবায় আছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১১ লাখ মানুষ এবং মারা গেছে ৬০ হাজারেরও বেশি। মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলো।
ফিরে আসি লেভেলার প্রসঙ্গে। মৃত্যু যে চূড়ান্ত লেভেলের বা পরম সমতাসাধক— এই ধারণাটি বোধ করি বহুলাংশে সমাদৃত হয়েছে মূলত: জেমস্ শার্লের ‘ডেথ দ্য লেভেলার’ কবিতার কারণে। এই কবিতাটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পেলেও শার্লে আদতে নাট্যকার। আর এই গীতি কবিতাটিও তাঁর একটি নাটক থেকে নেয়া। ১৬৫৯ সালে প্রথম প্রকাশিত সেই মঞ্চ নাটকটির নাম ‘The Contention of Ajax and Ulysses for the Armour of Achilles.’ স্পার্টার রাণী হেলেনকে অপহরণের পরিণতিতে সংগঠিত ট্রয়–যুদ্ধে অংশ নেয়া অন্যতম দুই বীরযোদ্ধা এই অ্যাজাক্স এবং ইউলিসিস। অ্যাজাক্স অ্যাকিলিস’র জ্ঞাতি ভাই। আর ইউলিসিস ওডিসিয়াস’র গ্রিক নাম। তিনি ইথাকার রাজা। একজন কৌশলী ও কুশলি বীরযোদ্ধা। ট্রয়-যুদ্ধে বিজয়ী হবার মূল রূপকার। মহাকবি হোমার রচিত ১২,১১০ লাইনের বৃহদাকার মহাকাব্য ‘ওডিসি’র কেন্দ্রিয় চরিত্র তিনি।
বীরশ্রেষ্ঠ অ্যাকিলিস’র দৈবিক বর্ম — যা কিনা দেবলোক অলিম্পাসের রাজকামার ও অগ্নিদেব হাফিস্টেসস কর্তৃক নির্মিত—এর উত্তরাধিকারী হবার দাবিকে কেন্দ্র করে এই দুই বীরযোদ্ধা যেবিরোধ ও বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে— সেই বাকবিতণ্ডাই এই নাটকের মূল উপজীব্য। এই দ্বন্দ্ব–কলহের অবসান ঘটে দেবী অ্যাথেনার কারসাজিতে, যিনি কিনা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সাহস, অনুপ্রেরণা, সভ্যতা, আইন ও ন্যায়বিচার, কৌশলগত যুদ্ধ, গণিত, শক্তি, কৌশল, চারুকলা, কারুশিল্প এবং দক্ষতার দেবী। এই দেবীর কূটচালে শেষতক এজ্যাক্স মানসিকস্থিতি হারিয়ে ফেলে। অপমানবোধে পর্যুদস্ত এজ্যাক্স অবশেষে নিজ তলোয়ারে নিজেকে বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করে। আর জেনারেলরা ইউলিসিসকে অ্যাকিলিসের বর্ম প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। নাটকটির দ্বিতীয় দৃশ্যে চিত্রিত হয়েছে অ্যাজাক্সের উন্মাদনা, পরাজয়, আত্মহননের দৃশ্য। আর সংক্ষিপ্ত চূড়ান্ত দৃশ্যে আজাক্সের বীরোচিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিত্র। এখানেই শেষ কৃত্তানুষ্ঠানের স্তবকীর্তনরূপে গীত হয়েছে শার্লের ‘ডেথ দ্য লেভেলার’ শিরোনামের কবিতাটি।
প্রভঙ্গত উল্লেখ্য, অ্যাকিলিস হলেন সেই গ্রীক মহাবীর যিনি মহাকবি হোমার রচিত মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’র কেন্দ্রিয় চরিত্র— ট্রয়–যুদ্ধে যার রয়েছে প্রতিপক্ষ ট্রোজানদের সর্বাধিনায়ক মহাবীর হেক্টরকে বধের কৃতিত্ব– যে হেক্টর একত্রিশ হাজার গ্রীক যোদ্ধাকে হত্যা করেছিলো। আর এই অ্যাকিলিস’র গভীর ক্রোধ ও রোষানলের বর্ণনার মাধ্যমেই সূচিত হয় ১৫,৬৯৩ লাইনের ওই বিশাল মহাকাব্যের ঘটনা পরম্পরা। হেলেনকে ( তার সম্মতিতে) অপহরণকারী ট্রোজান যুবরাজ প্যারিসের ছোঁড়া তীরে অ্যাকিলিস’র গোড়ালি বিদ্ধ হলে তিনি নিয়তি-নির্দিষ্ট মৃত্যু বরন করেন।
এইতো গেলো ওই নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনি। ফিরে আসি শার্লে’র কবিতার কথায়। শার্লে এলিজাবেথীয় যুগের লেখক। এ যুগের পরিসর ১৭ নভেম্বর ১৫৫৮ থেকে ২৪ মার্চ ১৬০৩ পর্যন্ত। শার্লে–কে বলা হয়ে থাকে ”সর্বশেষ এলিজাবেথন।” এর আংশিক কারণ, তিনি তাঁর যুগে জন্ম নেয়া সকল নাট্যকারদের মধ্যে সর্বশেষ (১৫৯৬ সালে লন্ডনে) এবং মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যেও ছিলেন সর্বশেষ (২৯ শে অক্টোবর, ১৬১৬)। তবে তারও বেশি প্রধান কারণ এই যে, শার্লে তার সাহিত্যকর্মে, বিশেষত কমেডির ক্ষেত্রে রেসটোরেশন যুগের মেজাজ – মানসকে ধারণ না করলেও অধিকাংশ উপাদান ও চরিত্র নিয়েছেন ওই যুগের জীবনাচার থেকে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সেগুলো তাঁর সমসাময়িক সাহিত্যিকদের শিল্প কর্মের সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ এবং আকর্ষণীয় সম্পর্কের সাক্ষর বহন করতো।
“ডেথ দ্য লেভেলার” কবিতাটি কবিতার প্রথম লাইনের শিরোনামে কিংবা ‘মৃত্যুর চূড়ান্ত বিজয়’ শিরোনামে বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটি মুখ্যত সর্বোচ্চ থেকে অতিতুচ্চ সকলের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর অপার শক্তিকে উচ্চকিত করে। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গীতযোগ্য এই শোকসঙ্গিত’র মোট স্তবক তিনটি। প্রতি স্তবক আট লাইনের। প্রথম স্তবকে কবি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য অবধারিতভাবেই মৃত্যু আসবে। দ্বিতীয় স্তবকে বীর যোদ্ধাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যুদ্ধে তাদের সাফল্যের বিপরীতে তারা নিজেরাই মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। বশ্যতা স্বীকার করবে মৃত্যুর কাছে। পরাভব মানবে এর পরাক্রমের কাছে। চূড়ান্ত স্তবকে কবি পাঠক ও দর্শকশ্রোতাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চান যে, যুদ্ধের শিকারী এবং শিকার,, বিজয়ী এবং বিজীত উভয়ই শেষ পর্যন্ত মারা যায়। সেভাবে এটাও নিশ্চিত যে, আমরাও মারা যাব, এবং যারা সম্মানের পাত্র তাদেরকে পরবর্তীতে স্মরণ করা হবে বিনম্র শ্রদ্ধায়।
এমন মহাদুর্যোগের দিনেও একটা মজার ঘটনা বলি। ক’মাস আগে এক রেস্তোরাঁয় আড্ডা শেষে আমার এক বন্ধু বললো, ‘যাই রে দোস্ত, দোয়া করিস’। আমি বললাম, ‘যা। দোয়া করি, আল্লাহ্ তোকে বেহেস্ত নসীব করুক!’ ক্ষেপে গেলো বন্ধুটি। বললো, ‘আরে, এটা তুই কী দোয়া করলি! আমি কি মারা গেছি নাকি!’ অন্য বন্ধুরাও ওকে স্বভাবসুলভ হাওয়া দিতে লাগলো। পরিণামে শুরু হলো আড্ডার দ্বিতীয় সেশন। আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন যুক্তিই হালে পানি পেলো না । সকলি ব্যর্থ চেষ্টা। আর নিদারুণ হৃদয় বিদারক পার্টটা হলো, আড্ডাজনিত পানাহারের সাকুল্য বিল চুকানোর সর্বসম্মত দণ্ড আমার উপরই আরোপিত হলো। দণ্ড অবিলম্বে কার্যকরও হলো। বলুনতো, যার এমন শুভানুধ্যায়ী বন্ধুচক্র আছে, সেই বন্ধুবধে কী আর কোনো বন্দুকের দরকার হয়?
আমার বিবেচনায় আমি আমার বন্ধুর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট শুভ-কামনাটাই করেছিলাম। যে জন্মেছে, সে মরবেই। মৃত্যু জীবনের মতোই সত্য। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন নদে।’ জন্মের জন্য মৃত্যু অবধারিত। হোক আগে বা পরে। কিন্তু শুভ-ইচ্ছের কি কোন এক্সপায়ারি ডেট আছে? কিংবা শুভ-কামনা কি তামাদি হয়? নাকি স্বর্গলাভে আমার বন্ধুর আপত্তি আছে? না, তা নয়। আসলে কোন মানুষই মরতে চায় না; তবে সবাই স্বর্গে যেতে চায়। মৃতদেহের শেষ গন্তব্যতো মাটিই, যদিও আত্মার শেষ ঠিকানা স্বর্গ কিংবা নরক। মৃত্যুরথে চড়েই মানুষকে লোকান্তরের স্বর্গরাজ্যে দাখিল হতে হয়। তবে কোন মানুষই সেই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে চায় না। কারণ সকল মানুষই স্বভাবগতভাবে মৃত্যুভয়ে কাতর। জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী জেনেও আমরা জগতের সবকিছুকে চিরস্থায়ী করতে চাই যা, আসলে নিরর্থক। জন্মসূত্রে মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি হলেও মৃত্যুই কেবল সেই বিভেদকে চিরতরে ঘুচিয়ে দেয়। মৃত্যুর মতো এতো পরম সমতাসাধক আর কিচ্ছুটি নেই।
১৭৭৬ সালে আমেরিকান বিপ্লবের সূচনালগ্নে জেফারসনের কলম থেকে উৎসারিত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত ‘All men are created equal’–– সকল মানুষ সৃষ্টিগতভাবে সমান— এই মৌল নীতি খোদ মিরকিন মুলুকেই কতোটা বিশ্বস্ততার সঙ্গে চর্চিত হয়েছে, তা তর্কাতীত নয়। বরং কালে কালে, দেশে দেশে আমরা দেখি মর্মান্তিক ভিন্ন চিত্র। জন্মসূত্রে আমাদের বংশ-কুল, জাত-বর্ণ, ধর্ম-গোত্র, শ্রেণি-পেশা, রূধির রেখা, সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক সঙ্গতি, পারিবারিক ঐতিহ্য, জাতীয়তা ও ভৌগোলিক সীমারেখাসহ নানান অর্থহীন অনুষঙ্গ বৈষম্যের সৃষ্টি করে রেখছে। স্থানকাল বিশেষে এ হীন বৈষম্যের আকার-আকৃতি ও প্রকার-প্রকৃতির তারতম্যই ঘটেছে মাত্র। উঁচু-নিচু, আশরাফ-আতরাফ, কৌলিন্যের তকমা সবি মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের মতো। তাতে বিধাতার মঞ্জুরি নেই। কারণ তিনি মানুষকে সাম্য-মৈত্রির বন্ধনে আবদ্ধ করে সৃষ্টি করেছেন। অসাম্যের কোন প্রবেশাধিকার তাঁর সাম্রাজ্যে নেই। বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে মানুষকে বিভক্ত করবার ঐশি ইচ্ছাটা সম্পর্কে জানা যাকঃ
‘‘হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারি থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’’ ( পবিত্র কোরআন- ৪৯:১৩)। অথচ মানুষ সেই প্রাকৃতিক বিধানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এই বাহ্যিক বিভাজনের বীজতলায় উপ্ত করছে বিভেদের বীজ। সেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত হচ্ছে বিষবৃক্ষ। আর অবাধে হচ্ছে পল্লবিত,পুষ্পিত ও ফলবতী। সেই বিষবনের কুশীলব পশুরাই জীবনের মঞ্চে মঞ্চস্থ কর চলেছে অন্তর্গত বিভেদ।
ঈশ্বর শোষণ, মানুষে মানুষে ছোট-বড় শ্রেণির ভেদাভেদ বা বৈষম্য সৃস্টি করতে বলেননি। তিনি চান তাঁর সন্তানরা সকলেই সকলের সঙ্গে সমব্যবহার করুন, পীড়িতের সেবা করুন। এই বিষয়ে সাম বেদের একটি শ্লোকের বঙ্গানুবাদ এরকম: ‘ঈশ্বর খুশি হন, যখন তুমি সমব্যবহারের মাধ্যমে কোনো মানুষের চিত্তকে আনন্দ প্রদান কর। দুঃখির দুঃখভার লাঘব কর, অত্যাচারিতের প্রতি অন্যায় আচরণের অবসান কর, আর্তকে সাহায্য কর এবং ক্ষুধার্তকে অন্নদান কর।’ সন্দেহ নেই, বিগত শতাব্দিগুলোর তুলনায় এক্ষেত্রেও মানুষের অর্জন বিংশ শতাব্দিতে অনেক উজ্জ্বল। কিন্তু কতোটা? বোমা-বারুদের সমাহার ও ব্যবহার যতোটা হয়েছে, সে হারে কি মানবিকতার চর্চা হয়েছে? না, হয়নি। কারণ, ‘অস্ত্র যেখানে পণ্য, যুদ্ধ সেখানে বিজ্ঞাপন।’
ফিরে আসি মূল কথায়। জেমস্ শার্লের কবিতাটির ভাবার্থের সঙ্গে থমাস গ্রে রচিত “Elegy Written in a Country Churchyard” কবিতার ৩৩–৩৬ পংক্তির সাযুজ্য লক্ষণীয়ঃ আভিজাত্যের অহংকার ও দর্প, ক্ষমতার দম্ভ, সৌন্দর্য বা সম্পদ,গর্ব কিংবা বৈভব; যা–ই মানুষকে দেয়া হয়েছে, সবই অবধারিতভাবে কেবলমাত্র সমাধির দিকেই ধাবিত হয়: “The boast of heraldry, the pomp of power/And all that beauty, all that wealth e’er gave/Awaits alike th’ inevitable hour/The paths of glory lead but to the grave.”
পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে ইংরেজ নাট্যকার ও কবি জেমস্ শার্লের DEATH THE LEVELLER রোণামের কবিতাটির বাংলা ভাবানুবাদ করে ‘মৃত্যু পরম সমতাসাধক’ শিরোনাম দেয়া হলোঃ
আমাদের বংশ–কুল, পদের গর্ব
সকলি অসার ছায়া, মায়া মরীচিকা;
নিয়তির প্রতিরোধে নেই-যে বর্ম
মৃত্যু শীতল হাতে কাড়ে রাজটিকা:
রাজদণ্ড মুকুটের ঝকমারি
ধুলোতেই খায় গড়াগড়ি।
তীক্ষ্ণ ধারে কোদাল শাবল না হোক তেমন সঙ্গিন,
সকল মৃতকে তবু সমহারে করে ধুলোতেই লীন।
মাঠের ফসল তলোয়ারে কাটে যারা
বধ্যভূমিতে করে নব বিজয়ের চাষ,
অবনত যখন; স্নায়ুর শক্তি হারা
বংশ ধারায় মৃত্যুর হাতে নাশ।
হোক আগু কিবা পিছু
নিয়তির কাছে মাথা নিচু
গড়গড় করে দম টানাটানি একদিন থেমে যায়,
নাচার পাণ্ডূ বন্দিরা যখন যমালয়ে পা বাড়ায়।
বিজয় মালার শোভা চোখের পলকে হবে নিমিষেই ম্লান:
দর্প চূর্ণ করে মুছে দেবে পরাক্রমের ক্ষীণ রেখাপাত;
মৃত্যুর বেদিমূলে বীরত্বের অহমিকার হবে বলিদান
যেখানে রক্তপাতে বিজিত ও বিজয়ীর দ্বৈত নিপাত।
উদ্যত শির যতো
সমাধির হিমে নতঃ
মাটির গর্ভে মিশে যায় তারা; শুভ-কর্মের নাই বিনাশ,
মাটিতে বিলীন দেহ – ধুলো ছড়ায় কীর্তিগাথার সেই সুবাস।