২০০২সালের ২০ মে প্রয়াত হলেন অলিতলা গ্রামের আতিকের বাবা মৌলভী হাবিবুর রহমান। বাবার ইন্তেকালের পর তিন ভাই ও এক বোনের পরিবারের একমাত্র অভিভাবক ছিলেন আতিকের মা সাহিদা বেগম। সাহিদা বেগম সংসারে হাল ধরলেন স্রোতের প্রতিকূলে। ২০০৯ সালে আতিকের মা শাহিদা বেগম স্টোক করেন, স্ট্রোক করার পর স্মৃতি ভারসাম্য হারিয়ে পেলেন, ২০১১ সালে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হন আতিকের মা। আতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পড়াশোনা শেষ করে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা কল্যানপুর গার্লস কলেজে সমাজ কল্যাণ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে আতিকের মনে শান্তি নেই স্বস্তি নেই।মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে আতিকের প্রাণ। অসুস্থ মা একা একা বাড়িতে থাকেন এই চিন্তা চেতনায় অস্থির হয়ে গেলেন আতিক। আতিক সেই সময় ভাবলেন, মা যদি আমার না থাকে আমার এই চাকরীর কোন প্রয়োজন নেই। মায়ের সেবাব্রতীর টানে চাকরী হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আবার চাকরী থেকে অব্যাহতি নিয়ে চলে এলেন চিরচেনা সবুজের হাতছানিময় অলিতলা গ্রামে।
মায়ের পাশে থেকে মা কে সেবা দিতে লাগলেন। এরি মধ্যে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে আতিকের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে যোগদানের চিঠি এলো। আতিক যোগদান মুহূর্তে জয়েনিং ভাইভাতে প্রধান কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন, স্যার আমার মা দুরারোধ্য ব্যধিতে বিছানায় শয্যাশায়ী, আমার মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার কাছে আমার মায়ের সেবাটা ভিক্ষা চাই? আমি আমার মায়ের সেবাটা করতে পারব যদি আপনি দয়াপরবশ আমার জয়েনিংটা বরুড়া উপজেলায় দেন, তারপর আপনি আমাকে বাংলাদেশেরে যেখানে চাকুরিতে পাঠাবেন আমার কোন আপত্তি থাকবে না, আমি কথা দিলাম আপনাকে। সেদিন আতিকের গল্প শুনে কৃষি কর্মকর্তা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। আতিকের চাওয়া অনুযায়ী অলিতলার পাশ্ববর্তী গ্রামে খোশবাস বাজারে অবস্থিত কৃষি ব্যাংকের শাখায় আতিককে জয়েন করতে নির্দেশ দিলেন। আতিক খোশবাস কৃষি ব্যাংকে মাত্র ৫,৫০০/- টাকা বেতনের কেশিয়ারের চাকরী পেয়ে প্রথম চাকরীর ১১০০০/- টাকা বেতনের চাকরীর দুঃখ অবলিলায় ভুলে গেলেন কারণ তাঁর কাছে টাকার চেয়েও অসুস্থ মায়ের সেবাটাই বড় হয়ে গেল।
দিন যায় রাত আসে, মাস যায় বছর আসে, রাতের অন্ধকার দূর হয়ে পূর্ণিমা আসে, আতিক তার মায়ের পাশে থাকেন। আতিকের মা কোন কথা বলতে পারেনা, শরীর নড়াচড়া করতে পারেনা কোন কিছু চাইতে জানেনা মৃতপ্রায় একটা মানুষ কে আতিক সেবা দিয়ে গেছেন মা মা করে। আতিকের আধোঘুমে আধোজাগরনের পর ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মায়ের পস্রাব পায়খানা করা কাপড় গুলো ধুয়ে নিতেন, মাকে গোসল করাতেন নীজ হাতে যেই ভাবে শৈশবে শিশুকে মা গোসল করিয়ে দিতেন, নিজে গোসল করে মাকে খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে কখন যে ৯:৪৫ মিনিট বেঁজে যেত, তরিঘরি করে নীজের কর্মস্থলে রওয়ানা দিতেন। কোন দিন সময় পেলে নিজে খেতেন আবার কোন দিনে না খেয়েই অভুক্ত অবস্থায় অফিসে চলে যেতেন। বিকেলে পাগলার ঘোড়ার মতো ছুটে আসতেন মায়ের বিছানার পাশে। এমন অনেকদিন গেছে মায়ের দুপুরের খাবার অফিস করে বিকেলে এসেই খাওয়াতে হয়েছে তবে মাকে না খাইয়ে কোনদিই তাঁর নিজের মুখে কোন খাবার উঠত না। বিকেলে বাড়িতে এসেই সারাদিনের ময়লা কাপড় আবার ধোয়া, মায়ের চুলে তৈল দিয়ে চুল গুলো বেঁধে দিতেন, মায়ের মাথার পাশে বসে হাত ভুলিয়ে দিতেন। কখন যে রাত নয়টা কিংবা ১০টা বেঁজে যেত তা টের পেতেন না। কোন কোন রাত আতিক তার চোখের জল দিয়ে নির্ঘুম মুখ মুছতেন। আতিক বাহিরের কাউকেই বুঝতে দিতেন না, মায়ের সেবা করেই রাত দিন আর অফিস টাইম পার করতে হত।
আতিকের বড় ভাই বিয়ে করে স্ত্রী বাচ্চা সহ কুমিল্লায় থাকতেন তখন মেঝো ভাই ও তার স্ত্রী বাড়িতে থেকে ভ্রুক্ষেপও করতেন না মায়ের দিকে। বড় বোন ছিল স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত! ২০১১ সালে ঢাকা হসপিটালে শেষবারেত মত ডাক্তার বলেছিলেন, আপনার মা বেশি দিন টিকবে না ভালোমতো কিছুদিন খাওয়ান। ২০১৫ সালে আতিক বিয়ে করেন। বাসর ঘরে স্ত্রীর কাছে পণ করে বসেন, স্ত্রীকে বলেন, “তাঁর মায়ের অভিযোগ বিহীন সেবা করতে হবে আর স্বামী হিসেবে সন্তুষ্টির জন্য আমার এটুকুই যতেষ্ট। স্ত্রী সেই রাতে স্বামীকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, আপনার চাওয়াটাই আমি যতদিন বাঁচি পূর্ণ করব। বাস্তবেই আতিকের স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিলি তার মায়ের সেবা করে যাচ্ছেন যেই ভাবে এতদিন আতিক দেখাশোনা করেছেন।
২০১১ সালে ডাক্তার বলেছিলেন, আপনার মা বেশি দিন টিকবে না সেই মা এখনো বেঁচে আছেন আতিক ও তার স্ত্রীর সেবাশুশ্রূষায়।
আপনারা নিশ্চয় জানেন, ঘুমের মধ্যে বায়েজিদ বোস্তামীর মা বায়েজিদ বোস্তামীকে বলেছিলেন এক গ্লাস পানি দিতে। বায়েজিদ বোস্তামী পানি নিয়ে এসেছেন। এসে দেখলেন মা ঘুমিয়ে গেছেন। আমরা যে কেউ হলে কি করতাম? হয়ত গ্লাসটা যত্ন করে কোথাও রেখে দিয়ে মাকে অনুসরণ করে অমনি গভীর ঘুমের ভিতর ঢলে পড়তাম। কিন্তু বায়েজিদের ব্যাপার কি হল? এমন কোন অজুহাত তুললেন না তিনি। পানি নিয়ে এসে দেখেন,মা ঘুমিয়ে গেছেন। মা পানি চেয়েছেন, প্রথম সুযোগে তাঁর হাতে তা তুলে দিতে হবে,কিন্তু তিনি তো এখন ঘুমে। এখন পানি দিতে গেলে ঘুম থেকে তুলে তাঁকে কষ্ট দেওয়া হবে। এখন কি কর্তব্য? পানি হাতে বোকার মত একঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন সারারাত, যেন মায়ের কল্যাণে শিয়রে প্রার্থনারত স্নিগ্ধ একরাশ হাস্নুহেনা। মার ঘুম ভাঙতেই তাঁর হাতে তুলে দিলেন গ্লাসটা।
বায়েজিদ বোস্তামী কেন করলেন এমনটা কারণ একটাই। তাঁর মায়ের জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল আমাদের মায়ের জন্যে আমাদের ভালোবাসার চেয়ে বেশি। মায়ের সুখ-দুঃখ ভালো-মন্দের জন্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ছিল আমাদের চেয়ে বেশি। তেমনি একজন মা ভক্ত খোশবাস ইউনিয়নের অলিতলা গ্রামের কৃষি ব্যাংকের অফিসার আতিকের মায়ের গল্পটা বলার চেষ্টা করেছি। আতিক একজন মেধাবী মানুষ হয়েও এমন অবোধ শিশুর মতো আচরণ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়নি; যা কোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষও হয়ত করত না। ভালোবাসা মানুষকে কতখানি নির্বোধ করে দিতে পারে, তার সর্বোচ্চ উদাহরণ আমাদের আতিক। তাই আতিক শুধু সাধারণ গল্প হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে মানবজাতির জীবন্ত কিংবদন্তি, তার জীবনের আচরণীয় আদর্শ।