করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা পৃথিবী থমকে আছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল ইউরোপের দেশগুলোতে। টেলিভিশনের খবর আর ফেসবুকজুড়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান আর সচেতনতার বার্তা। বৈশ্বিক মহামারি এই ব্যাধিতে আক্রান্ত আমাদের স্বদেশও। আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও উৎকণ্ঠার কোনো কমতি নেই যেন।
করোনা ভাইরাসের কারনে লকডাউন করে দেয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন সেই সাথে স্কুল, কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । তারই ধারাবাহিকতায় লকডাউন করা হয়েছে খোশবাস ইউনিয়নও। ব্যস্ততার এই নগরে হঠাৎ করেই সবকিছু থমকে গেছে। যেখানে খুব ভোর থেকেই শুরু হত মানুষের আনাগোনা। ছাত্রছাত্রীদের পদধুলীতে মুখরিত হত খোশবাস স্কুলের প্রাঙ্গণ। তবে এখন, প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বেরোচ্ছেনা সাধারণ মানুষ। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। ঘরের মধ্যে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে গ্রামে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই।
পৃথিবীর এই ভয়াবহ মুহূর্তে সব থেমে থাকলেও থেমে নেই প্রকৃতির আপন খেলা। প্রকৃতি যেন মত্ব তার আপন সাজে।
বুধবার (৬ মে) দেখা যায় খোশবাস ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একমাত্র বিদ্যাপিঠ খোশবাস উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ বৈকালিক স্নিগ্ধতায় সেজেছে মনোরম এক সাজে। সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে পুরো মাঠ। গ্রীষ্ম যেন আকড়ে ধরে রেখেছে বসন্তের অপরূপ সৌন্দরতা। গাছপালা মেলেছে তার সবুজ পাতার শাখা-প্রশাখা। দু একটা দোয়েল পাখি শিশ দিয়ে যায় গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। এই লকডাউনেও দু-একজন কিশোর কে দেখা যায় প্রকৃতির এই লীলা উপলব্ধি করতে। দিনের ক্লান্তি শেষে পশ্চিমাকাশে রক্তিম আলোর ছটা ছড়িয়ে দিয়ে ডুবতে শুরু করেছে স্বর্গের আঁখি! আকাশে ছোপ ছোপ মেঘ। দিগন্তরেখার চারপাশ আগুনরঙায় আলোকিত! ঘরে ফেরা পাখিদের দল উড়ে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। প্রকৃতির অপরিমেয় সৌন্দর্যময় অকৃত্রিম মায়াময় রূপ বঞ্চিত করেনি কাউকে। ঘিরে রেখেছে স্কুলের বিভিন্ন ভবন থেকে শুরু করে দিগন্ত জোড়া মাঠ। পাখির চোখে বিস্তৃত সবুজের মাঝে বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে ভবনগুলো। আর তাই হয়তো পরিবেশ সচেতন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতির রূপ ঘেরা সবুজ-শ্যামল বাংলাকে অবলোকন করে বলেছেন:
‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ
ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ’
মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে প্রকৃতি নেই, সেখানে জীবনের সন্ধান নেই। স্কুল আঙিনার নানান জাতের গাছগাছালির সমারোহ এ ক্যাম্পাসকে দিয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। শুধু একনিষ্ট প্রকৃতি প্রেমীর কাছে নয়, পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিদেরও করেছে বিমোহিত। করোনার আতঙ্কে যখন ক্যাম্পাস হয়ে পড়েছে স্থবির, তখন উঁচু উঁচু মেহগুনি গাছ, আমড়া গাছ, জাম গাছ, নারিকেল গাছ তরতর করে লাফিয়ে বড় হচ্ছে। ইষ্টু-পুষ্ট হচ্ছে মাঠের সবুজ নরম ঘাস। কোনো মহামাহির আতঙ্ক নেই ওদের চোখে মুখে। ক্যম্পাসের বুকে কান পাতলেই এখন দিনভর এক প্রাণোচ্ছ্বাসের মর্মধ্বনি শোনা যায়।
সবমিলিয়ে প্রকৃতির এই দৃশ্য ছিল বেশ মনোরম। অন্যান্য সময়, সারাদিন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পদতলে মরে যায় সবুজ ঘাস। বিকেল হলেই এই যায়গায় আড্ডায় মত্ব হয় গ্রামের মানুষ। চারদিকে বিভিন্ন দোকান-পাটের যান্ত্রণাদায়ক শব্দ! যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত হর্ণ! খেলাধুলায় মেতে থাকে গ্রামের খেলাপ্রিয় যুবকরা। প্রকৃতি যেন পেরেই উঠেনা মানুষের এই কর্মকান্ডকে। সবমিলিয়ে উদ্ভট এক অবস্থা বিরাজ করে এই বিদ্যাপিঠের চারপাশ ঘিরে।
প্রকৃতি পৃথিবীর কাছে জীবন ও মৃত্যু, সভ্যতা ও সংকট, প্রলয় ও সৃষ্টি, পূর্ণতা ও নির্মূলের একাত্মতার প্রতীক। কিন্তু মানুষ এ সত্য ভুলে যায়। ভুলে যায় এই প্রকৃতি কেবল মানুষের একার নয়, ওরাও এর সমান দাবিদার। আর তাই প্রকৃতি যখন মানব সৃষ্ট অত্যাচারের সঙ্গে পেরে উঠে না। তখন অতিষ্ঠ প্রকৃতি মহামারির মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখে।